লোকের কথায় জীবন ক্ষয়


প্রকাশের সময় : আগস্ট ২১, ২০২২, ৫:২৮ অপরাহ্ণ / ৬২১
লোকের কথায় জীবন ক্ষয়

মো ঃ মামুন মোল্যা 

ফাহাদ মিয়া সহজ সরল গ্রামের একজন কৃষক। বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছরের
কাছাকাছি। মা বাবা এবং স্ত্রী সহ দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। বাবার বসত-ভিটা বাদে জমি ছিল মাত্র দশ কানি। সেই জমিতে যে ফসল ফলে, তিন মাসের খাবার কোন মতে চলে। বাকি নয় মাস পরের খেতে শ্রম দিয়ে সংসার চালাতে হয়। খেয়ে
না খেয়ে ছেলে-মেয়ে দুটি মানুষ করতে,অভাবের সাথে লড়াই করছে দিনরাত। কারণ স্বপ্ন একটাই, ছেলে মেয়ে শিক্ষিত হবে। বড় চাকরি করবে। দেশ ও দশের মঙ্গলে কাজ করবে। শান্তি পাবে মনে, মুক্তি পাবে অভাব থেকে। সেই স্বপ্ন নিয়ে ছেলেটি কে এম এ পাস করিয়েছে। ছেলেটি চাকরির লিখিত পরীক্ষায় টিকলে কি হবে? ভাইভা পরীক্ষায় অর্থ মামা খালু রাজনীতির সার্টিফিকেট যোগ করতে বলে। ছেলেটি এই গুলি যখন যোগ করতে ব্যর্থ হয় তখন ফলাফল অকৃতকার্য আসে। তাইতো আজ সোনার ছেলেটি সরকারি চাকরির পিছে ছুটতে ছুটতে বড্ড ক্লান্ত।
মেয়েটিও
এইচএসসি পড়ছে। ছেলেটির বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষা দিবার জন্য ধার করে টাকা দিতে দিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনা হয়েছে। ফাহাদ মিয়া কে তারা
সব সময় টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ দিক আগের তুলনায় ফাহাদ মিয়ার সংসার খরচ
দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তার মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ও বেড়ে চলেছে। এক দিন কাজ হলে দুই দিন বসে থাকতে হয়। কি ভাবে যে সংসার চালাবে? কি ভাবে যে দেনা শোধ হবে? ফাহাদ মিয়া ভেবে কোন কুল কিনারা পায় না। ছেলেটি তার মা বাবা কে অনেক ভালোবাসে। একদিন ছেলেটি তার বাবাকে পুকুর পাড়ে বসে কাঁদতে দেখে। ছেলেটির বুঝতে বাকি থাকে না কেন তিনি কাঁদছেন ? ছেলেটি বাবার কান্না দেখে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে কাজের সন্ধানে ঢাকার দিকে রওনা দেয়। দীর্ঘদিন হওয়া সত্ত্বেও  ছেলেটি বাড়ি কোন যোগাযোগ
করে না।
কারণ একটায় সে এক লক্ষ টাকা আয় না করা পর্যন্ত কোন যোগাযোগ করবে না। এ দিকে মা বাবা ছেলের চিন্তায় অস্থির। বাবা ছেলের দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেছে। মেয়েটি তার বাবা কে শত সান্ত্বনা দিচ্ছে কিন্তু কোন সান্ত্বনায় কাজ হয় না। ফাহাদ মিয়া ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায়। গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। যা মন চাই তাই করে। খাওয়া দাওয়ার ও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। মা মেয়ে তো আর পথে পথে ঘুরে বেড়ালে চলে না। মা বাধ্য হয়ে পরের বাড়ি কাজ করে। যে অর্থ পায় তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলে। মেয়েটি টিউশনি করে নিজের লেখা-পড়ার পাশাপাশি সংসার খরচের জন্য কম বেশি টাকা দেয়। ছেলেটি বাড়ি ছেড়ে
কোম্পানির অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে চাকরির জন্য। সব অফিসের স্যার দের কথা
একটায়।
এই অফিসে চাকরির জন্য কোন মাধ্যম আছে ?পূর্বের কোন অভিজ্ঞতা আছে ? এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে আছে কিন্তু উত্তর দিলে যে ফল ভালো হবে না তাই চুপ থেকে চলে আসে । মনটা খুব খারাপ। এক রিকশায় উঠে বন্ধুর বাসায়
যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রিকশাওয়ালা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখে দুই চোখ বেয়ে জল ঝরছে৷ । রিকশাওয়ালা বলিল ভাই আপনার কি হয়েছে ? ছেলেটি সব কথা খুলে বললে
রিকশাওয়ালা বলিল ভাই বর্তমান বাংলাদেশ টা হয়ে গেছে মামা খালুর। মামা খালু না
থাকলে এ দেশে চাকরির আশায় জুতা ক্ষয় করে লাভ নেই। ছেলেটি বলিল আপনার কথাই যথার্থ। আমি এখন বড় অসহায়। আমাকে একটা কাজ খুঁজে দিবেন? রিকশাওয়ালা বলিল, আপনি শিক্ষিত মানুষ। আমি আপনাকে কি কাজ খুঁজে দিব? আমি বড় জোর আপনার দিক বিবেচনা করে জামিন থেকে একটি রিকশা ভাড়া করে
এনে দিতে পারি।
ছেলেটি বলিল ঠিক আছে তাই দেন। আমি রিকশা চালাবো। দীর্ঘ দশ মাস রিকশা চালিয়ে খরচ বাদে এক লক্ষ টাকা জমা করে। বাড়ি ফোন করতে যেন সুখের হাওয়া লেগেছে তাদের মনে। মা বোন খুশিতে দিশাহারা। ছেলেটি তার
মাকে বলে বাবার কাছে ফোন দাও। মা বলিল তোর শোকে তোর বাবা পাগল হয়ে গেছে। কোথায় যায়? কোথায় থাকে? কি খায়? কোনো ঠিক নেই। ছেলেটি বলিল মা তুমি চিন্তা করনা । আমার কথা শুনলে বাবা ঠিক হয়ে যাবে।
মা আমি
একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করছি। থাকা খাওয়া বাদে দশ হাজার টাকা দেয়। মা আমি প্রতিজ্ঞা করছিলাম এক লক্ষ টাকা আয় না করে বাড়ি যোগাযোগ করবো না। আজ এক লক্ষ জমিয়েছি। তাই আজ ফোন দিছি তুমি বাবা কে খুঁজে এনে তার হাতে টাকা দিবে দেখবে বাবা ভালো হয়ে গেছে। মা তার মেয়ে কে তার বাবাকে
খুঁজতে পাঠায়। মেয়েটি তার বাবা কে খুঁজতে খুঁজতে বড্ড ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য একটি বট গাছের ছায়ায় বসিল। হঠাৎ তার বাবা উপস্থিত। মেয়েটি তার
বাবা কে দেখে কেঁদে ফেলে। আর বলে বাবা ভাইয়া বেঁচে আছে। সকাল দশটার দিকে ফোন দিছিল এবং তোমার সাথে কথা বলবে বলে আমাকে তোমাকে খুঁজতে পাঠিয়েছে মা। আরো একটি সু-খবর আছে এক লক্ষ টাকা পাঠিয়েছে। আর আমাদের কষ্ট নেই। বাবা ছেলের কথা শুনে আগের মত ভালো হয়ে যায়। খুশিতে কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবা হঠাৎ বলে উঠলো মা রে তোর ভাইয়া কি কাজ করে কিছু বলছে? জি বাবা ভাইয়া বলেছে সে নাকি একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি
করে। থাকা খাওয়া বাদে দশ হাজার টাকা দেয়। আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূর্ণ করেছে।
গ্রামের যে মানুষের সাথে দেখা হয় আনন্দে তারে বলে আমার ছেলে বড় চাকরি পেয়েছে। আমার হাড় ভাঙা কষ্ট আজ সফল হয়েছে। গ্রামের লোকও চাকরির কথা শুনে বেশ খুশি। বেশ কিছুদিন পর শুভ নামে গ্রামের এক ছেলে ঢাকায় চাকরির জন্য যায়। শুভ অফিসের যাওয়ার জন্য একটি রিকশা ডাকলো। রিকশাওয়ালা কাছে আসলে দেখে ওদের গ্রামের ফাহাদ মিয়ার ছেলে সাজু। ছেলেটি ভাবে ফাহাদ মিয়া বললো তার ছেলে চাকরি করে। এখন একি দেখছি ? সাজু ভাই আপনি নাকি বড়
কোম্পানিতে চাকরি করেন? সাজু কোন উত্তর দিল না। শুভ চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি
আসে।
শুভ বিকালে বাজারে ঘুরতে যায়। সেখানে দেখা হয় ফাহাদ মিয়ার সাথে। বাজারে অনেক মানুষ। অনেক মানুষের মাঝে সে বলিল কাকা আপনার ছেলের সাথে দেখা হয়েছে এবং কথাও হয়েছে। আপনার ছেলে একটা বাটপার কারণ সে আপনাকে বলছে সে বড় কোম্পানিতে চাকরি করে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। সে ঢাকায়
রিকশা চালায় আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। এমন ছেলের বাবা না হয়ে মরে
যাওয়া অনেক ভালো। ফাহাদ মিয়া তার কথায় ভীষণ কষ্ট পায়। আমার ছেলে বাটপার?
মিথ্যাবাদী? আমার শিক্ষিত ছেলে রিকশা চালক? এই কথা ভাবতে ভাবতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
শেষ পর্যন্ত ছেলেটির কথায় ফাহাদ মিয়ার মৃত্যু ডেকে আনে।