পরমান্ন


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ১৭, ২০২৪, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ / ১৪
পরমান্ন

সোহিনী ঘোষ

মোঃ মোমিন ইসলাম সরকার পঞ্চগড় জেলা প্রতিনিধিঃ ঠেলায় যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করা রামু যাত্রীদের মুখের নানা গল্প রোজই তার কানে আসে। সব কথায় সে কান দেয় না। তবে আজ ঠেলায় দু-জন মহিলা যাত্রী উঠেছিল। তাদের আলোচনা কানে আসছিল রামুর।

বাড়ি ফিরে তার মাকে রোজ তার সামান্য রোজগারের সামান্য অর্থ তুলে দেয়। রামুর আরো দুটো ভাই বোন আছে। বাবা হঠাৎই মারা যায় তাই রামুকে পেট চালানোর খরচ জোগার করতে হয়।

রামুর মা রাস্তা ঝাড় দেয় কখনো। আর বাবুর বাসায় কাজ করে। বস্তির এক ঝুপড়ি ঘরে কোনমতে তারা চারজন থাকে। খুব অভাবে দিন কাটে। রামুর সামান্য রোজগার আর মা যা রোজগার করে তা দিয়ে কোনমতে দিন কাটে।

রামু বাড়ি ফিরে আজ মাকে বলে মা তুমি পরমান্ন জানো?বানাতে পারো? মা জানতে চায় এই নাম তুই কোথা থেকে শুনলি? রামু বলল আজ ঠেলায় দুজন গল্প করছিল খুব স্বাদ তারা বানিয়েছিল।

রামুর মায়ের মনটা খারাপ হয়ে যায়। এমন পোড়া কপাল যে ছেলে মেয়েদের মুখে ভাতের সাথে একটু ভাল কিছু তুলে দিতে পারে না। আর পরমান্ন তো অনেক দূর। মা চুপ করে থাকে।

রামু বলে বাবুদের বাড়ি তো কাজ করো জানো না মা কেমন করে বানায়?খাও নি?দেয় নি ওরা কোনদিন তোমায়? মা জানায় হ্যাঁ একদিন দিয়েছিল আমি তো এনে তোকে দিয়েছিলাম।

রামুর মনে পড়ল হ্যাঁ তো একদিন খেয়েছিল। মিষ্টি খেতে কিন্তু ঠিক মনে নেই স্বাদটা। রামু বলল একদিন পরমান্ন রান্না করবে মা?

মা বলে ওতে যে অনেক খরচ রে আমরা কি করে করব? এত টাকা খরচ করবো কি করে? সামনে বর্ষা আসছে ঘরের চালটা এবার ছাইতেই হবে রে রামু। যে কটা টাকা পাই তা যদি খরচ করি কি করে চালটা ঠিক করব?

ঠিক আছে একদিন বানিয়ে দেব। কটা দিন যাক বাবুদের বাড়ির মাইনেটা পাই তারপর ঠিক বানাব। অপেক্ষা করে রামু। সবে মাসের কটা দিন গেছে। মাইনে পেতে অনেক দেরী। সে জানতে চায় কি কি লাগে মা? মনে মনে ঠিক করে রামু সেগুলো নিজেই কিনে আনবে।

মায়ের থেকে জেনে নেয় ঠিকই কিন্তু দোকানে গিয়ে জানে অনেক খরচ। টাকা মাকে দেয় আর অল্প অল্প করে জমাতে থাকে নিজের কাছে। একদিন সে সব কিছু কিনে নিয়ে আসে আর মা-কে বলে মা আজ পরমান্ন বানাও। রাতে ফিরে আমরা সবাই মিলে খাব।

খুশি খুশি কাজে বেরিয়ে যায় সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া রামু। মা বাড়ি ফিরে পরমান্ন রান্না করে রামুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অনেক রাত হয়ে যায় রামু এখনো ফেরে নি। মা আনচান করতে থাকে। ছোট ছোট ভাই বোন তারাও অপেক্ষা করে দাদা ফিরলে সবাই একসাথে মজা করে খাবে। ভাল-মন্দ তাদের তেমন জোটে না। আজ খুব মজার দিন।

মা রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে রামুর জন্য। মন বড় অস্থির হতে থাকে। কোথা থেকে খবর পাবে রামুর? সারারাত বাড়ি ফেরে না রামু। অপেক্ষা করতে করতে ছোট ভাই বোনেরা ঘুমিয়ে পড়ে। মায়েরও সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে যায় ঘুমে।

সূর্যের আলো চোখে পড়ে ঘুম ভেঙে যায় দেখে রামু এখনো বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেল কি হলো রামুর? বেলা বাড়তে কাজে যেতে হবে কিন্তু মন শরীর কোনোটাই যেন সায় দিচ্ছে না মায়ের। তার রামু ঘরে ফেরে নি। খবর পায় নি।

কাজে যাবার পথে শোনে কাল সন্ধ্যায় নাকি একটি ঠেলাগাড়িকে একটি লরি ধাক্কা দিয়েছে। ঠেলা চালক হাসপাতালে ভর্তি। মায়ের মন, হঠাৎ মনে হয় এ ঠেলা চালক তার ছেলে রামু নয় তো? কান্নায় ভেঙে পড়ে কিন্তু কাঁদলে চলবে না। খোঁজ নেয় কোন হাসপাতালে আছে তার ছেলে।

গিয়ে সে আর তার ছেলেকে দেখতে পায় না। ছেলে তখন মর্গে। মৃত একটা ডেডবডি। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে রামুর মা। এ কি হল বাবা। এত কষ্ট করে সব জোগাড় করে অনলি এত স্বাদ এত ইচ্ছে ভগবান কি নির্দয় তুমি ছেলেটাকে মুখের খাবার টুকু খেতে দিলে না।

রামুর আর পরমান্ন খাওয়া হল না। কারোর ই আর মুখে উঠল না কত কষ্টের রোজগারের কত সাধের পরমান্ন।

গরীব মানুষদের সাধ হয় কিন্তু পূরণ হয় না তা সব সময়। রামুর মনের ইচ্ছে মনেই রয়ে গেল।