ধারাবাহিক উপন্যাস ” জলে ও আগুনে “


প্রকাশের সময় : জুলাই ২৫, ২০২২, ৫:০৫ অপরাহ্ণ / ৭৫৬
ধারাবাহিক উপন্যাস ” জলে ও আগুনে “

সুব্রত শুভ

৬.
পড়ন্ত বিকেল। মিতুর মোবাইলে রিংটন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখল মিতু। অপরিচিত নাম্বার। সবুজ বাটনে টাচ করে কলটি রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে খুবঐ পরিচিত কন্ঠে ভেসে আসতে লাগলো শব্দ তরঙ্গ…
– হ্যালো মিতু, ভালোই আছো তাহলে নতুন নাগরকে নিয়ে তাইনা? মনে আছে সেই রাতের কথা? নাকি আবারও কোন এক রাতে…..
কথাটা শেষ হতে না দিয়েই কলটা কেটে দিয়ে ফোনের সুইচ বন্ধ করে দিল মিতু। ফোন খোলা রাখলে বারবার রিংটোন বাজতে থাকবে। মিতু আনমনে অনেকক্ষণ জানালার সুপারি চটা গোল করে বানানো গ্রীলে কপাল ঠেকিয়ে বাইরের পড়ন্ত বিকেলের রং দেখতে লাগলো। পড়ন্ত বিকেলের রং দেখতে মন্দ নয়। দিন-রাত প্রতিক্ষণের রঙেই পার্থক্য আছে। সকল সময়ের রঙেই আছে ভিন্ন ভিন্ন মুগ্ধতা অথবা বিষাদ!
মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। পাশের মসজিদের মুয়াজ্জিন বয়সে প্রবীণ। গরীব পাড়াগাঁয়ের মসজিদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্ক মুয়াজ্জিন রাখা হয়। বয়স্ক মানুষের মাইনে কম। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা শব্দটা বড়ই অর্থহীন। আসলে সব যুক্তি সর্ব ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত নয়।  শিশু, এবং মহিলাদের মাইনেও সাধারণত খুবঐ কম। গরীব মানুষের মাইনেও অনেক কমই হয়ে থাকে।
– মিতু রে…! একটু এদিকে আয় তো মা! আমার হয়েছে যত জ্বালা!
মায়ের চিৎকার শুনে মিতুর জ্ঞান ফিরলো অবস্থা! হতচকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গোয়াল ঘরে মায়ের কাছে ছুটে গেল মিতু।
– কি হয়েছে মা? চিৎকার করছো কেন?
– মরার বাছুরটা ছুটে গোয়াল থেকে বেরিয়ে বাঁশ বাগানের দিকে ঢুকেছে। তুই হাস গুলোকে পুকুর থেকে তাড়িয়ে খাঁচায় তোলার ব্যবস্থা কর তো! পশুদিন সন্ধ্যায় খাঁচার মুখ থেকে বনবিড়ালের তাড়া খেয়ে ওরা এখন খাঁচায় ঢুকতে ভয় পায়। আমি দেখি বাছুরটা গেল কই। তোর বাবা হয়েছে আরেক জমিদার! কত করে বলেছি – সন্ধ্যায় বাড়ি থাকবে, সন্ধ্যায় বাড়ি থাকবে! হাস মুরগি গরু ছাগল নিয়ে মাথা খারাপ অবস্থা সন্ধ্যায়! আর উনি ভদ্দোরলোক সন্ধ্যা হতে না হতেই মোড়ের দোকানে যান চা পানে! আ হা হা হা হা…! ভাত পান না চা খায়! আমার হয়েছে যত জ্বালা!
– আ হা মা! তুমি অমন করে বলছ কেন! বোঝইতো মা, সারাদিন একটা মানুষ অসুস্থ শরীর নিয়েও আমাদের জন্য কতইতো পরিশ্রম করে। আর সন্ধ্যায় না-হয় একটু চা খেতেই গেল! তার জন্য তুমি অমন করে বলবে?
– নে হয়েছে! বাপের পক্ষে ওকালতি না করে যা করতে বল্লাম তাই কর! আমি দেখি মরার বাছুরটা গেল কই! সালার কপাল আমার!
বিড়বিড় করতে করতে বাঁশ বাগান পার হয়ে খোলা মাঠে বাছুরের সন্ধানে নেমে পড়লেন মর্জিনা বেগম।

৭.
আজ আমাদের বাড়িতে আমার খালাতো বোন পারুল এসেছে। পারুল এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে যাবে। সেকেন্ড ইয়ারের পরিক্ষা শেষ করেই সোজা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসার অবশ্য অন্য একটা কারণ ও আছে। কারণটা খুবই গোপনীয়। পারুল আর আমি ছাড়া এই কারণটা অন্য আর কেউ জানে না। পারুল খুব বিনীতভাবে আমাকে এই কারণটা অন্য কাউকে না জানাতে অনুরোধ করেছে! আমিও ওর অমন নরম অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারিনি এতকাল। কিন্তু এবার আর ওর অমন অনুরোধটা রাখতে পারবো কি পারবো না বুঝতে পারছি না! মিতুকে কি সবকিছু খুলেই বলতে হবে? না! মিতুকেও আমার আর পারুলের ওই ব্যপারটা বলা যাবে না। যাকে সব বলা যায়- তাকেও সমস্ত বলা ঠিক না। কিছু কথা আছে যা যাকে বলা যায় তাকেও বলতে নেই। বললেই বালাই।
– কি রে দাদা! আমি এলে কি করতে হয় সেটাওকি ভুলে গেলি?
ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট ভেংচে বল্ল পারুল। আমি ওর মুখে এমন কথা শোনার জন্য সেই মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ওর কথার কি উত্তর করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবুও বিড়বিড় করে বললাম
– ওটা না হয় রাতেই হবে!

৮.
রুমির সাথে আমার যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটা ছিল আমার জীবনে খানিকটা দুঃস্বপ্নের মতো। রুমিকে দেখলে যে কোন পুরুষের পুরুষত্ব চাঁড়া দিতে বাধ্য। খানিক’টা সর্ট ফিগারের মেয়ে। স্বাস্থবতী সুন্দরী তরুণী রুমি। পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানও আকর্ষণীয়। মিষ্টি মিষ্টি কালার কম্বিনেশন। পারফেক্ট পারফিউম। সব মিলিয়ে দারুণ, অবর্ননীয়!
আমি প্রথম প্রথম ওকে দেখে আকর্ষিত হলেও এড়িয়ে চলতে সচেষ্ট ছিলাম তুঙ্গে। তুমুল প্রচেষ্টা চালিয়েও পরিশেষে শেষ রক্ষা সম্ভব হয়নি কিছুতেই।
সেদিন ছিল শুক্রবার। সকাল বেলা আমার ফোনে কল এলো পারুলের। আমাকে জোরেশোরে বলা হল বিকেলে আমি যেন ওদের বাড়িতে যাই, এবং সেই রাতে ওদের বাড়িতে থাকতে হবে সেইমত আমি যেন প্রস্তুতি নিয়ে যাই। পারুলের এমন জোরালো দাবিকে আমি দাবিয়ে দিতে পারলাম না। তাছাড়া আমি তো  তখনও রুমির বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলাম না। আমি তখনও ভাবতেও পারিনি যে পারুল আমাকে রুমির সাথে অমনটি ঘটিয়ে দিতে অমন জোরালো ভাবে ডেকে নিচ্ছে আমাকে। বিষয়টি বুঝলাম ঘটনা যখন ঘটলো।
রুমি আর পারুল ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ওরা যদিও বয়সে দুই বছরের ছোট বড় কিন্তু প্রতিবেশী সম্পর্কে বন্ধু ওরা। ছোটবেলা থেকেই আমার যাওয়া আসা পারুলদের বাড়ি। সেই সূত্রে রুমির সাথেও স্বাভাবিক  সম্পর্ক আমার। তবে সেই সম্পর্ক ওই পর্যায়ে পৌঁছাবে সেটা আমার কাছে অকল্পনীয়ই বটে। অথচ ওইদিন ওটাই ঘটিয়ে দিল প্রকৃতি আমাদের। প্রকৃতি প্রকৃতই প্রকট!

৯.
সবেমাত্র আমি আর পারুল একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে উঠেছি। আমি সোফায় বসে বসে একটা কবিতার বই হাতে নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছি মাত্র। পারুল গা এলিয়ে বিছানায় সুয়ে সুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে আর আমার মোবাইল চাপছে। এভাবে করতে করতে কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আমার মোবাইলে মিতুর ফোন এলো। ফোনটা রিসিভ করলো পারুল। পরুল বললো
– হ্যালো! কে বলছিলেন?
মিতু হতচকিত হয়ে বল্ল
– ইয়ে… আমি মিতু, আপনি কে বলছিলেন?
– আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি পারুল! অভি আমার খালাতো ভাই।
– ও আচ্ছা। এবারতো তবে চিনলাম তাইনা?
– হুম, অভি কে হয় আপনার?
– ইয়ে মানে… আসলে অভি আমার আত্মীয় মত কিছু হয় না। বন্ধু বল্লে বলা যায় এটুকু আরকি।
– ও আচ্ছা। তাহলে তো আপনি ওর ব্যক্তিগত অনেক কিছুই জানেন তাই-না? রুমির বিষয়ে ও কিছু বলেছে আপনাকে?
– না তো। কে রুমি?
– ও আচ্ছা। অভির কাছেই না হয় শুনে নিবেন তাহলে।
– আচ্ছা দেখা যাক। অভি কোথায়? ওকে কি ফোনটা দেওয়া যাবে?
– সোফায় ঘুমোচ্ছে বোধয়। ডেকে দিব?
– না থাক তাহলে । পরে কথা বলবো। রাখি তবে এখন হ্যাঁ?
– আচ্ছা।

১০.
রাত কিছুটা বেড়েছে। রাতের খাবার খেয়ে আমরা যে যার মতো টুকিটাকি কাজ বাজ সেরে নিয়েছি। পারুল আর আমার বোন টুম্পা টিভি রুমে বসে বসে গল্প করছে আর টিভি দেখছে। মা আর বাবা তানাদের সোবার রুমে সুয়ে সুয়ে টুকিটাকি কথাবার্তা বলাবলি করছে। আমি আমার রুমে বসে বসে একটা উপন্যাসের কাজ করছিলাম। হঠাৎ করে আমার বাইরে বেরতে মন চাইলো! একটু রাত বাড়লে আমার বাড়ির পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটাহাঁটি করতে খুব ভালো লাগে আমার। নির্জনতায় একা একা হাঁটাহাঁটি করলে নিজেকে চিনতে সহজ হয়। নিজেকে নিজে একান্তে একাকি সময়টুকুই কেবল নিজের জন্য কিছু করার সময়। বাদবাকি সময়ে আমরা আসলে নিজের জন্য নয় বরং যা-কিছু করি তা করি কেবল পরিজনের জন্য। যে চিন্তা সেই কাজ। ভাবনার বাইরে কিছুই করতে ভালো লাগেনা আমার। তবুও যে ভাবনার বাইরে কিছুই করিনা তা নয়। করি। তবে যা কিছু ভাবনার বাইরে করি তা আমার জন্য নয়। তা করি কেবল ওই পরিজনের জন্য। এগুলোও করতে হয়, আবার ওগুলোও করতে হয়। আসলে মানুষকে সবই করতে হয়। যা কিছু করা যায় তাও করতে হয়, আবার যা কিছু করা যায় না তাও করতে হয়।
বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। মৃদু মোলায়েম জ্যোৎস্না। হালকা বায়ু প্রবাহ। না শীত না গরম। চরম এক পরিবেশ বিরাজ করছে প্রকৃতিতে আজ। আজ আমি রাজা! রাজ্যের যতো নেশা সব নেশাই জেকে বসেছে আমার মাথায়।মেঠোপথে আমি কেবল নেশা অশক্ত  হাঁটছি আর হাঁটছি। একবার সামনে যাই, আবার পেছনে ফিরে আসি। সীমার মধ্যে আসীম এই পথ। আমার এই হাঁটাহাঁটিও চলছে তেমন সীমা থেকে আসীমে। কখন রাত বাড়তে বাড়তে এখন যে কখন হয়েছে তা আর আমার মনে নেই। আমি কেবল আমাতেই হারাতে বসেছি মাত্র। শেষ বার যখন গন্তব্যের গোড়া হতে আগার দিকে রওনা করবো, ঠিক তখনই ছায়ার মতো মনে হলো আমার পেছনেও কেউ একজন হাঁটছে। পেছন ফিরে আবছা আলো আঁধারে দেখি পারুলের কচি কোমল মুখ। ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও বল্লো –
আমিও তোমার সাথে হাটঁবো!
আমি বললাম হাটঁতে চাইলে আরম্ভ করো। শুরু হলো আমাদের অন্ধকারে আঁধার কেলির  প্রথম পদক্ষেপ।

(চলবে)