ছোটগল্প..…… শেষ পত্র


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২, ২:২১ অপরাহ্ণ / ১৯০
ছোটগল্প..…… শেষ পত্র
  1. ছোটগল্প???
    ..…… শেষ পত্র…. …

    সুখন আমার কফিটা বারান্দায় দিয়ে যাও।

    বিকেলের শান্ত রোদ। চারিদিকে শরতের মিষ্টি হাওয়া বইছে। সূর্যটা পশ্চিম কোণে হেলে পড়েছে। গোধুলীর রক্তিম আভায় চারিদিক মায়াময় স্নিগ্ধ হয়ে আছে।চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো সুনীল। সিগারেট মুখে নিল। আধশোয়া হয়ে সিগারেট টানছে আর আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অতীতের কাছে ফিরে গেল। সত্যি কি অম্লমধুর ছিল সেই দিনগুলো।
    কৃষ্ণচূড়া খোঁপায় গুঁজে হালকা নীল শাড়ি, দুগাছি কাঁচের চুড়ি কপালে ছোট একটা টিপ পড়ে মৃন্ময়ী যখন আমার সামনে আসতো মনে হতো যেন আকাশের নীল পরীটা নেমে এলো ধরায়। এত মিষ্টি লাগতো দেখতে। দুহাতে দুটি গালে একটু আদর দিলে একেবারে লাজে রাঙা লাল হয়ে উঠতো। কি অপূর্ব মোহময় মুখটা আমার প্রেয়সীর। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো। চাঁদ মুখে হাসি ফুটে থাকতো সবসময়। গালে দুপাশে টোল পড়ত।কি অপূর্ব রূপবতী ছিল আমার মৃন্ময়ী।

    সিগারেট শেষ করে চেয়ারে টানটান হয়ে বসলো সুনীল।
    সুখন আমার কাগজ কলম দিয়ে যাও তো।
    এক গ্লাস পানি দিয়ে যেও।
    সুখন আসলো কাগজ কলম আর পানি নিয়ে।বলল আজ কি রান্না অইব স্যার?
    সুনীল বলল তোমার যা ইচ্ছে হয় রান্না করে নাও। আজকে আমাকে একদম বিরক্ত করবে না। আজকে আমি একটু দেরিতে খাব।  আমার খাবার টেবিলে ঢাকনা দিয়ে রেখে তুমি খেয়ে শুয়ে পড়।

    সুখন চলে যেতেই আবার একটা সিগারেট ধরালো সুনীল।  অনেক দ্রুত সিগারেট টা শেষ করল।
    আজ মৃন্ময়ীকে কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে।  আজকের অবসরটা মৃন্ময়ীকে উৎসর্গ করতে চাই।
    লিখা শুরু করলো সুনীল।

    প্রিয়
    মৃন্ময়ী
    কেমন আছ? অনেক দিন পর লিখছি।হয়তো এটা শেষ পত্র ও হতে পারে তোমাকে লিখা। কারণ  এই চিঠি পোস্ট করার সুযোগ হয়তো আসবে না কখনো।হাজারো পত্র লিখে মনের ডায়েরিতে জমা রেখেছি।আজ হঠাৎ একটি সুযোগ পেলাম পত্র লিখার।তাই এই সুযোগ টি দ্রুত লুফে নিলাম প্রিয়। জানি তুমি আজ যোজন যোজন দূরে আমার থেকে।কিন্তু কখনো কি ভেবেছ এমন একটি সময় আমাদের জীবনে আসবে? আমরা কালের স্রোতে বিলীন হবো নাম না জানা বাঁকে?  এমন তো কথা ছিলনা মৃন্ময়ী।
    কেন এমন হলো? কেন নিয়তির এমন নির্মম পরিহাস মেনে নিতে হলো নীরবে? জানি কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। তবু ও কেন যে প্রশ্নগুলো এত পোড়ায় জানি না।

    অতীতের স্মৃতি মনে পড়লে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যায়। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এর মতো মনে ঝড় উঠে।চোখের কোনে জল ভরে উঠে।নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। কখনো যদি ভুল করে আমায় মনে কর তবে খুঁজে নিও তোমার চোখের গভীর দৃষ্টিতে যেখানে জমা আছে আমার মায়াবী আহবান। যদি ভালোবাসা হাতড়ে বেড়াও তবে তোমার বুকে একটি হাত রেখো আমার ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করবে। যদি কখনো মনে হয় খুব একা মনে হচ্ছে নিজেকে তবে আমার কবিতার বই খুলে বসো নিভৃতে। দেখবে আমি সঙ্গী হয়েছি তোমার নিঃসঙ্গতার। আমার কবিতার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে তোমাকে বলা সব কথা,সব স্বপ্ন,সকল আকুলতা।

    দূরে থেকেও মন থেকে দুজনের কথোপকথনে সময় পার হবে কবিতার কাব্যিক পরমানন্দের টানে। আহারে জীবন কত কথার বুননে মুখরিত ছিল। সময়ের পর সময় কেটেছে কতশত একান্তে দুজনের। স্মৃতিরা এলোমেলো হয়ে রয়ে গেল জীবন নামক মহাকাব্যে। হয়তো মৃত্যুতেই সমস্ত ভাবাবেগের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু মৃত্যু কাছে আসলেই বাড়ে বেঁচে থাকার  আকুতি। বাড়ে তোমাকে একটি বার দেখার তৃষ্ণা।  জানি জন্মিলে মরিতে হবে। এই কঠিন সত্যি টা আজ বড্ড কাছে দাঁড়িয়ে আছে।৷ বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা আজো অন্তরে জাগরূক। শুধু একটাই আশা যদি মৃন্ময়ীকে খুঁজে পাই।যদি মৃন্ময়ীর সাথে দেখা হয়।

    তুমি কি এখনো তেমনি আছ আগের মতো খুব জানতে ইচ্ছে করে।  তোমার সুনীল এখনো আগের মতোই আছে। তোমার প্রেমের বিশালতার আকাশ ভেঙে আমার কাছে আসার স্পর্ধা কেউ দেখায়নি।কারণ সবাই জানে সুনীলের স্বপ্ন মৃন্ময়ীতে শুরু মৃন্ময়ীতে শেষ। তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। মনে আছে তোমার? আমি সেই দিনটির কথা আজো ভুলিনি। তোমার ঠাকুরমা অসুস্থ ছিল তাকে দেখতে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সহপাঠী মিলে। ঠাকুমাকে তুমি আগেই বলেছ আমাদের সম্পর্কের কথা। তাই সবার অন্তরালে ইশারা করে ঠাকুরমা আমাকে কাছে ডেকে বসালো।
    আমার হাত ধরে বলল দাদুভাই আমার আদরের মিনুকে তুমি যত্নে রেখো। বড় ভালো মেয়ে আমার নাতনি। তুমি ওর একমাত্র আশ্রয়। ছোটবেলায় মা হারানো আমার নাতনিটা সবার অনাদর অবহেলা সহ্য করেছে। কাউকে কিছু বলত না। আমার কোলে মুখ লুকিয়ে কান্না করত।তুমি দেখবে তো মিনুকে?  কথা দাও। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটাকে ছুঁয়ে আমি কথা দিয়েছিলাম সেদিন। আমি তোমাকে পরম ভালোবাসায় পরম যত্নে রাখব।
    কিছু দিন পর ঠাকুরমা পরবাসী হলেন। তারও বেশ কিছুদিন পর আমাদের দেখা করার সুযোগ হলো।

    তুমি দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে কি কান্না।কোনোভাবে থামানো যাচ্ছিল না শুধু কেঁদে কেঁদে এক কথা বলে যাচ্ছিলে আমার আশ্রয় টা হারিয়ে গেল।আমি কি করব?  কষ্ট পেলে কার কাছে গিয়ে হালকা হবো?
    অনেক কষ্টে তোমাকে শান্ত করলাম।দুহাতে মুখটা ছুঁয়ে বললাম এই পাগলী আমি আছি তো। কেন এত ভয় পাচ্ছ।আমি আছি সবসময় তোমার জন্য। চলো ওই নদীর ধারে গিয়ে বসি তোমার ভালো লাগবে।
    নদীর ঝিরিঝিরি বাতাস তোমার এলোমেলো চুল বারবার মুখের উপর চলে আসছে।আমি তোমার মুখের চুল সরিয়ে দিচ্ছি আর আলতো পরশে আলিঙ্গন করে আছি। কি অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠেছিল সেদিন। বারবার মনে হচ্ছিল ইস্ মৃন্ময়ীকে যদি নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারতাম কি যে ভালো হতো।
    শোনো মৃন্ময়ী আমি একটি চাকরির খবর পেয়েছি আমার এক বন্ধু জানালো। ভাবছি শহরে যাব।বি, এ পরীক্ষা ও যেহেতু শেষ এবার তো চাকরির চেষ্ঠা করতে হবে। চাকরির পাশাপাশি না হয় বাকী পড়াশোনা শেষ করব কি বলো? আমি চাকরি পেলে আমাদের একসাথে পথ চলতে আর কোনো বাঁধা থাকবে না।

    তুমি সম্মতি দিয়ে বললে, আমিও চাই আমরা একসাথে ঘর বাঁধি।পরেরদিন আমি শহরে চলে আসলাম।

    দু’মাস পর বাড়ি ফিরলাম। তোমার খবর নিতে তোমার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। পথে আমার বন্ধুর সাথে দেখা। শুনলাম তোমরা কলকাতা পাড়ি জমিয়েছ। হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল তোমার পরিবার সব শুনলাম আমার বন্ধুর কাছে। এক গভীর রাতে দূর্বৃত্তরা তোমাদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। পারিবারিক শত্রুতা থেকে তোমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছে তাই তোমরা অসহায় হয়ে কলকাতা এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে চলে গেছ। আমার বন্ধুর কাছে দুকলম চিঠি লিখে রেখে গেলে।
    প্রিয়
    নীল,
    তোমাকে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। আমাকে ক্ষমা করো। তোমার ভালোবাসা সাথে নিয়ে অজানার পথে পা বাড়ালাম। আমার ভালোবাসা তোমার কাছে যত্নে রেখো।
    ভালোবাসি ভালোবাসব শুধু তোমাকেই।
    ইতি তোমার
    মৃন্ময়ী।

    বুঝলাম খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে তুমি পত্রটি লিখেছ। অনেক কান্না পাচ্ছিল চিঠিটা পড়ে। ছোট চিঠি অল্প কথার। কিন্তু আমাকে একেবারে স্তব্দ করে দিল তোমার চিঠির প্রতিটি শব্দ। তবুও বন্ধুর সামনে নিজেকে কোনোভাবে সামলে বাড়ি ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে বসে ছিলাম।
    গ্রামে ফিরে ওই চিঠিখানাই ছিল আমার কাছে তোমার শেষ স্মৃতি। চিঠির লিখাগুলো আজ অনেকটা ঝাপসা।  কিন্তু তুমি আমার কাছে আজো ঝলমলে এক টুকরো চাঁদ।  এক মূহুর্তের জন্য ও তোমাকে আমি ভুলতে পারিনি।আজো ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে। আমার কবিতায় তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি আমি। রোজ তোমার সাথে কথা বলি,ভালোবাসি, অভিমান করি।
    যদি তোমার আগে চলে যাই এই পৃথিবী ছেড়ে তবে ক্ষমা করো মোর অপরাধ যতো। ভালোবেসে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ রেখে যেও আমার স্মৃতি স্তম্ভে।
    এইটুকু জেনে রেখো তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। চিরকাল এই ভালোবাসা একই রকম থাকবে। সব কিছু পরিবর্তন হলেও কিন্তু এই একই রকম ভাবে আমি ভালোবেসে যাব তোমাকে।
    ভালো থেকো প্রিয়।
    ইতি
    তোমার স্মৃতিপটের ভালোবাসা
    সুনীল।