ধারাবাহিক উপন্যাস ” জলে ও আগুনে ” ১


প্রকাশের সময় : জুলাই ২৫, ২০২২, ৪:৫৮ অপরাহ্ণ / ৭৫০
ধারাবাহিক উপন্যাস ” জলে ও আগুনে ” ১

সুব্রত শুভ

১.

মিতুর আজ সবকিছু খুলে বলার কথা। কেমন করে ওই নরপিশাচ মিতুকে ওইসব করেছিল সেই সবের বিস্তারিত। যদিও কিছু কিছু কথা কাউকেই কোনদিন বলা চলে না- তবুও ওই সমস্ত কথাই কাউকে না কাউকে অবশ্যই বলতে হয় কখনও না কখনও। মিতুও বলবে আজ আমাকে সবকিছু।

– “আমার সবকিছু জানার পরেওকি আমি তোমার বুকে এমন নির্ভয়ে মাথা রেখে তোমাকে আমার হৃদয়ের সব কথা খুলে বলতে পারবো নিলয়?”
আমার বুকের বাম পাশে মাথা রেখে ডান বুকে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল মিতু।
” হ্যাঁ পারবে মিতু!” – এমনটাই বলার কথা ছিলো আমার। কিন্তু তেমনটা বলতে পারলাম না কেন যেন! আমি বোল্লাম অন্য কথা।
– আচ্ছা মিতু আমাকে একটা প্রসঙ্গে একটু গুছিয়ে বলতে পারবে তুমি?
– বিষয়টাতো আগে বলবে নাকি?
– সে তো বলতেই হবে! আমার বিশ্বাস তুমি পারবে!
– আমার উপর এতো জোরালো বিশ্বাস কোথায় পাও নিলয়? নাকি আমার হৃদয় গলাবার জন্য এমন সব ভোলানো-ভালানো প্রলাপ করো?
– আমি জানি মিতু- ভোলা ভালা মেয়ে তুমি নও। তোমাকে চিনতে পেরেছি আমি। আসলে তোমাকে চিনতে পারাটাকে আমি খুব বড় মাপের কোন প্রাপ্তিকেই বুঝি। মানুষ চেনাটাই মানুষের আসল যোগ্যতার পরিচয়। তার উপরে তোমার মতো একটা মানুষকে চেনা! এ এক পরম গৌরব বলেই মনে হয় আমার নিজেকে……!
– আরে বাবা তোমার কাব্যিকতা রেখে এবার আসল কথা বলোতো একটু শুনি!
আমি যে মিতুকে কি বলতে চেয়েছিলাম সেটাই এখন আর মনে করতে পারছি না। অথচা সেই না মনে পড়া কথাটাই আমার জীবনের সারকথা! সর্বচ্চ সেই কথাটাকে মনে করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে চলেছি…….!

২.

জাহিদ ছিল মিতুর ছোট বেলার বন্ধু। একদম ছোট বেলার। ছোটবেলায় ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী সকলের একটাই পরিচয় থাকে। আর তা হলো মানুষ। ক্রমে ক্রমে ক্রমান্বয়ে মানুষ যখন বড় হতে থাকে, তখন মানুষের পরিচয়ও বদলাতে বদলাতে অন্যরকমও হতে থাকতে পারে। এই যেমন- রক্ষক-ভক্ষক, ধনী-দরিদ্র, আমলা- কামলা, মানুষ-অমানুষ ইত্যাদি। বিষয়টির গভীরতার অতো কিছু মিতুরা তখনও আন্দাজ করতে পারেনা কিছুতেই। জাহিদেরা আন্দাজ করতে পারে কি পারে না সেটা বলতে না পারলেও এটুকু অন্ততো বলতে পারি যে- জলে আগুন নিভলেও আগুনে জল জ্বলতে ব্যর্থ!

৩.
মিতু আজ আমাকে যে জঘন্য  ঘটনাটার কথা খুলে বলবে ওই ঘটনাটা ঘটেছিল গভীর রাতে। ওই জাতীয় ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাতেই ঘটে থাকে। দুই প্রকার ঘটনা রাতেই বেশি বেশি ঘটে। এক- বিখ্যাত ঘটনা, আর দুই- কুখ্যাত ঘটনা। সেই সূত্রে মিতুর সাথে ওই কুখ্যাত ঘটনাটা গভীর রাতেই ঘটতে হয়েছে।

মিতুর একান্ত বান্ধবী তমা। তমা ততোটাই মিতুর একান্ত – যতোটা একান্ত না হলে কেউ কারো ওইরকম সর্বনাশ অন্তত করতে পারেনা। সেই রাতে তমাই মিতুকে একাকি ওই ঘটনার ঘটনাস্থলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আর মিতুকে ডেকে নিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ওই ঘরে রেখে ঘটনার একটুখানি আগমুহূর্তে-ই কি এক অযুহাতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর তমা যখন মিতুর কাছে ফিরে এলো- ঘটনা তখন শেষ হয়ে কিছুটা মাত্র সময় পার হয়েছে। তমা তখন মিতুর দিকে না তাকিয়েই মিতুর হাত ধরে টেনে ঘরথেকে বের করে মিতুর বাড়ির দিকে রওনা করল। মিতু মাথা নিচু করে তমাকে অনুসরণ করে এগতে লাগলো।

৪.
মিতু এখনও আমার বাম বুকে মাথা রেখে ডান বুকে ওর বাম হাতটা মৃদু মোলায়েম করে চলেছে। মিতু যে কথাটা আমাকে আজ খুলে বলবে ওই কথাটা শোনার জন্য আমার একটু উদগ্রীব হবারই কথা ছিল। কিন্তু কেন যেন তেমন কিছুই মনে হচ্ছেনা আমার। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? বরং এই প্রশ্নের উত্তর  খুঁজে পেতে ইচ্ছে করছে খুব! আমার কাছে এমনটাই মনে হচ্ছে যে- ওর জীবনে ঘটে যাওয়া জঘন্য ঘটনাটা শোনার চেয়ে বরং আমি-ই আমার জীবনের আমার এক অমানুষিক বর্বরতার গল্পটাই শুনিয়ে দেই ওকে। যদিও এই গল্পটা কাউকেই কোনদিন বলবনা ভেবেছিলাম তবুও মিতুকে খুলে বলতে ইচ্ছে করছে সবকিছু! কিন্তু এমনটাই বা হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর টাও জানতে ইচ্ছে করছে খুব!

আমিও তখন খানিকটা ছোট। ছোট বলতে ততোটা আবার নয়- যতোটা ছোট হলে  রোকছানার উপর জোর করে অমন পৌচাশিক কান্ডটা ঘটাতে পারতাম। মোটের উপর আবেগি একটা বয়স তখন আমার। নিজের ভেতরের পশুত্বকে চিনতে পারলেও নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর যে বয়সটাতে। তাই যদি না হয় তবে হয়তোবা অনুশোচনা শব্দটাই নিরর্থক হয়ে পড়তো!

হঠাৎ করেই মিতুর মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল। হতচকিয়ে আমার বুক থেকে উঠে পড়ল মিতু।
– হ্যালো মা!
– কিরে মিতু, কোথায় তুই?
– ইয়ে মনে…. আমিতো ক্যাম্পাসে মা।
– তাহলে এক কাজ করিসতো মা, বাসায় ফেরার সময় তোর বাবার প্রেশারের কিছু ঔষধ নিয়ে আসিস তো মা।
– বাসায় ঔষধ নেই মা?
– নারে মা। তোর বাবার প্রেসারটাও একটু বেড়েছে মনে হয়। মনে করে ফেরার সময় ঔষধ নিয়ে আসিস মা।
– বাবার শরীর এখন কেমন?
– না ততোটা খারাপ নয় যে এখনই তড়িঘড়ি করে তোকে কিছু করতে হবে। যখন ফিরবি তখন নিয়ে আসলেই হবে।
– আচ্ছা আমি দেখছি মা। তুমি বাবার দিকে একটু খেয়াল রেখ হ্যাঁ!
– আচ্ছা রাখবো। তুই আবার তড়িঘড়ি করিসনা যেন! কলেজ শেষ করে তারপর আনলেই হবে।
– আচ্ছা রাখো।
– আচ্ছা!
ফোনটা কেটে দিয়ে-ই মিতুর মুখে অস্থিরতার চিহ্ন ফুটে উঠলো। আমি ওকে বল্লাম- তোমার এখন বাড়ি ফেরা উচিৎ।  মিতুও আনমনে উঠতে আরম্ভ করল। আমার ওকে অন্তত খানিকটা পথ হলেও এগিয়ে দেওয়া উচিৎ! আমিও ওর সাথে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। একবার ভাবলাম এই সময়ে ওর হাতটা ধরে হাটা উচিৎ হবে কি-না!  কিন্তু উচিৎ অনুচিত ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি আমরা দু’জনে…..!

৫.
মিতু যখন বাসায় পৌঁছাল তখন সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। মিতুর বাবা খায়রুজ্জামান সাহেব অবসন্ন মনে একটা কেদারায় বসে বসে ঝিমাচ্ছেন। মা মর্জিনা বেগম ব্যস্ত আছেন সদ্যজাত মুরগির ছানাগুলো নিয়ে। মুরগির বাচ্চাগুলোর চোখে কি যেন সমস্যা হয়েছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে আর চোখ বন্ধ করে ঝিম দিচ্ছে অধিকাংশ বাচ্চাগুলো। এমনিতেই সতেরোটা ডিম তা দিয়ে বাচ্চা ফুটেছে মাত্র নয়টা,  তারপর মরেছে একটা আর একটাকে বেজিতে নেওয়ার পর বাচ্চা অবশিষ্ট আছে মাত্র সাতটা। আর এই সাতটা বাচ্চার মধ্যে আবার একটা জন্মেছে এক পা পঙ্গু নিয়ে। সুস্থসবল বাচ্চা ছিল পাঁচটা,  তার আবার তিনটারই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর ঝিমুনি দিচ্ছে। গ্রামের সব বাড়িতেই মুরগির মহামারী দেখা দিয়েছে। গ্রামের সব মুরগিই প্রায় উজাড়। মিতুদের মুরগিতেও মড়ক লেগেছে। বড় মুরগিগুলো মরে মরে সবগুলোই প্রায় শেষের পথে। এমনকি মর্জিনা বেগম এমনটাই ধরে নিয়েছেন যে- এই বাচ্চাগুলোর মা মুরগিটা ছাড়া আর একটা মুরগিও বাঁচবে না! মা মুরগীটাই একমাত্র বেঁচে থাকবে। ছোট বাচ্চা থাকলে সে মা মুরগি সাধারণত অসুখে মরে না। বিধাতার এ এক অসাধারণতা! তাইবলেতো আর হাল ছেড়ে দেওয়া চলেনা! বাচ্চাগুলোকে একটু বিশেষ খেয়ালে রেখে যদি বাঁচানো যায়! তাই তিনি স্বামী সন্তানের পাশাপাশি এই মুরগির বাচ্চাগুলোর দিকেও বিশেষ খেয়াল রেখে চলেছেন।

মিতু খানিকটা রাগান্বিত স্বরেই মা কে বল্ল- মা! তোমাকে বল্লাম বাবার দিকে খেয়াল রাখতে, আর তুমি কিন মুরগির বাচ্চাগুলো নিয়েই পড়ে আছো?
– কি যে বলিস নারে মা, আমাকে কি তোর ওইরকম মনে হয়! এইমাত্রই আমি তোর বাবার কাছ থেকে উঠানে নেমেছি।
– আচ্ছা বেশ হয়েছে। এবার নাও এই ওষুধগুলো ধরো। আমি একটু হাত-পা ধুয়ে আসছি। বাবা দুপুরে ভাত খেয়েছে?
– নারে মা। বারবার বল্লাম- খেয়ে নাও খেয়ে নাও! কিন্তু কে শোনে কার কথা। বল্ল- মিতু আসুক তারপর বাপবেটি একসাথে খাবো।
– উফফফফ! তোমরা যে কি করো! বুঝেছি! তুমিও খাওনি তাহলে। তাহলে এসো টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে একসাথে সবাই খেয়ে নেই।
– তুই তোর বাবাকে নিয়ে বসতেলাগ মা, আমি গরুটাকে একটু ছায়া যায়গায় বেঁধে রেখে আসছি।
– আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি বাবাকে খাইয়ে তারপর ঔষধগুলো খাওয়াই।

মিতু বাবাকে খাইয়ে দাইয়ে ঔষধ খাইয়ে তারপর মা’কে ডেকে মা মেয়ে একসাথে খেয়ে নিল। খেতে খেতে ঝাল ভর্তার খুবই প্রশংসা করতে লাগলো মিতু। আর নিজের রান্নায় নিজেই প্রশংসা করা যায়না বলে হ্যালেংচা শাক আর আলু দিয়ে ছোট পুঁটি মাছের ঝোলের প্রশংসা করতে পারছিলেন না মর্জিনা বেগম। খাওয়া শেষে তেতুলের টক বাটিতে করে চুমুক দিতে দিতে মিতু বল্ল- সবকিছুই চমৎকার!
এবার ঠোঁটের কোনায় একটু মুচকি হাসলেন মর্জিনা বেগম। শত কষ্টের আকাশেও এ যেন এক তৃতীয়া তিথির চাঁদ!

(চলবে)