ধারাবাহিক উপন্যাস “জলে ও আগুনে ” তৃতীয় অংশ


প্রকাশের সময় : আগস্ট ৭, ২০২২, ২:২১ পূর্বাহ্ণ / ৭৬৮
ধারাবাহিক উপন্যাস “জলে ও আগুনে ” তৃতীয় অংশ

সুব্রত শুভ

১১.
তমা আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি সে কথা মিতুকে জানালাম। মিতু কেমন চমকে উঠলো। আমি হতবাক হলাম না।
– কি হলো মিতু? অমন চুপ মেরে গেলে? আচ্ছা চলো নদীর পাড়ে ঘুরে আসা যাক খানিক!
– আমার আজ শরীরটা খুব বেশি ভালো লাগছে না অভ্র। আমরা না হয় কাল বিকেলে নদীর পাড়ে ঘুরবো!
আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল নদীর পাড়ে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করি! নদী মানুষের হৃদয় বোঝে। হৃদয়ের যত গ্লানি, যত তাপ-উত্তাপ, পাপ, শাপ সবকিছু নদীর কাছে যেন কিছুই না!
মিতুকে আর একবার অনুরোধ করবো ভাবলাম। কিন্তু করলাম না। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে সেটা করাতে গেলে বরং সেটার উল্টোটাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মিতুকে আজ ছুটি দিয়ে দিতে হবে। হৃদয় যেখানে তার তৃপ্তি পায় না, হৃদয়কে সেখানে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে নেই। মিতুকে বাড়ি অভিমুখে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে নিজেই রওনা হলাম নদীর দিকে। যেতে যেতে ভাবলাম পারুলকে ফোন করে ডেকে আনি। সব সময়ই ও আমাকে বোঝে। কিন্তু গত রাতের ঘটনাটা আমাকে কেমন লজ্জিত করছিল। পারুলকে ডাকলাম না। আমি একাই গেলাম। পড়ন্ত বিকেলী নদী। নদীর স্রোতেও কেমন এক পড়ন্ত আভা। পাড়ের গাছপালা গুলোও কেমন ক্লান্ত। নদীর উপর পড়ন্ত সূর্যের আলোও কেমন নিস্তেজ। সবকিছু কেমন নেভা নেভা ভাব। ওদিকে দিনের আলো টুকুনও কেমন নিভে নিভে আসছে। বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে এবার। বাড়ি ফেরার কথা মাথায় আসতেই দারুণ এক শিহরণ দোলা দিলো হৃদয়ে। পরক্ষণেই কি এক পাপ বোধ ঘিরে ধরলো আমাকে। আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। প্রথমে ঘাশের উপর বসলাম। তারপর শরীর এলিয়ে পড়ল মাটিতে।

১২.
– কি রে মিতু! রাত অনেক হলো। খাবি না মা?
– আমার খিদে নেই মা। বাবা খেয়েছে?
– তোর বাবা খেয়েদেয়ে মোড়ের দোকানের দিকে গিয়েছে। চল আমরা খেয়ে নেই!
– না মা। আমি খাবো না। তুমি খেয়ে নাও।
– কেন রে? খাবি না কেন? খেয়েছিস তো সেই দুপুরে।
– বল্লাম তো খাবো না। তুমি যাওতো।
– তোর প্রিয় খাবার রান্না করেছিলাম মা। পুইশাক আর মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে ছোট চিংড়ি।
– উফ……!
– আচ্ছা… আচ্ছা!
খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছেন মর্জিনা বেগম। খানিকক্ষণ পর খায়রুজ্জামান সাহেব ও বাড়ি ফিরে গোয়াল ঘরে গিয়ে গোবর গুছিয়ে, মুরগির ঘরের দিকে টর্চ লাইট মেরে, টিউবওয়েল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে রুমি গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
রাত বাড়ছে। টেবিলে বসে বসে কি সমস্ত ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত দু’টো বেজে গেছে মিতু তার কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো মিতু। ইদানিং ঘুমের বেশ সমস্যা হচ্ছে মিতুর। ঘুম আসতে চায় না। যাপনের এ এক মহা বিভ্রান্তি!
বালিশে মাথা রেখে এপাশ ওপাশ করতে করতে ক্রমশ রাত্রি বাড়ছে। রাত বাড়তে বাড়তে ফুরিয়ে এলো প্রায়। আড়াই টা, তিনটা, সাড়ে তিনটা, চারটা…… বাজতে বাজতে ফুরিয়ে গেল রাত। হয়তো এরই মধ্যে কোন এক সময় মিতুর ঝিমটি মত কিছুটা ঘুম হয়েছে কিংবা হয়নি! ছয়টা নাগাদ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল মিতু। শরীর কেমন ম্যাচ ম্যাচ করছে। রাতে ঘুম না হলে যেমনটা হয়। ঘুম থেকে উঠে গোসল করার প্রয়োজন অনুভব করলো মিতু। কলসি টা নিয়ে নদীর দিকে রওনা করল মিতু।
সকাল সকাল গোসল করার একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে। কেমন এক মায়াবী শীতল অনুভূতি। এক কথায় দারুণ!

১৩.
– ইদানিং তুমি আমাকে কেমন এড়িয়ে চলতে চাইছো অভি, কারণটা জানতে পারি কি?
– কেন? কি হয়েছে পারুল? এমনটা মনে হচ্ছে কেন তোমার?
– এমনি!
– এমনি আবার হয় নাকি? কিছুতো কারণ আছে। একটু খুলে বললে বুঝতে সুবিধে হতো।
– এই সব বেপার আসলে বোঝানো যায় না, তবে বোঝা যায়।
– হুম। আসলেই তুমি ঠিকই ধরেছ পারুল। ইদানিং কি যেন একটা সমস্যা হচ্ছে আমার। আসলে সত্য বলতে কি জানো পারুল?  আমার যে কি হয়েছে সেটা আমি নিজেও জানি না। অনেক দিন পর গত রাতে রুমিকে স্বপ্নে দেখলাম। রুমি কেমন আছে আছে পারুল?
– ও আচ্ছা! তাহলে আজই তুমি রুমিকে দেখতে যাবে আমার সাথে। গুছিয়ে নাও!
বলেই পারুল বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমি আর কিছুই বলার সুযোগ পেলাম না।

১৪.
পারুল দের বাড়ি পৌঁছালাম বিকেল নাগাদ। আমাকে দেখে চমকে উঠলো খালা!
– আরে এ আমি কি দেখছি! অভি যে! কেমন আছিস বাপ?
– ভালো আছি খালা। তোমার শরীর কেমন আছে?
– আর শরীর! আছি আরকি।
– খালুকে দেখছিনা যে।
– তোর খালু তো রাত করে বাসায় ফিরছে ইদানিং। ব্যাংক ক্লোজিং এর মাস। কাজের চাপ খুব।
– ও আচ্ছা। তা খালুর শরীর কেমন?
– প্রেশারটা বেড়েছে। তার উপরে কাজের চাপ খুব। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় থাকি রে অভি!
– দুশ্চিন্তার কিছু নেই খালা। সমস্যা দিচ্ছেন যিনি, সমাধানও দিবেন তিনি।
– তোর বাড়ির সবাই কেমন আছে অভি?
– ভালো আছে খালা। মা তোমাকে খুব মিচ করে। তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছে।
– দেখা যাবে। এখন হাত মুখ ধুয়ে নে। চা নাস্তা দিচ্ছি।
– আচ্ছা খালা।
পারুল তোয়ালে এনে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এলাম। টিভি রুমে বসে টিভি অন করলাম। চা নাস্তা নিয়ে আমার পাশে এসে বসলো পারুল।
– আজ রাত ১১টায় পুকুর পাড়ে থাকবে তুমি। মা বাবা ঘুমালে আমি চলে আসবো তোমার কাছে। মনে আছে অভি দা, সেই আমাদের প্রথম রাতের কথা? কোন এক রাতে পুকুর পাড়ের আম গাছের নিচে…!
লজ্জায় মাথা নিচু করল পারুল। আমি লজ্জা পেলাম না।

১৫.
সন্ধ্যার আগমুহূর্ত। খালা বাড়ির পাশের রাস্তা ধরে হাটাহাটি করছি। ফোন এল মিতুর। আমি কিছুটা ইতস্ততা বোধ করলাম। পারুলদের বাড়িতে এসেছি মিতু জানে না। ওকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ করে চলে এসেছি। কাজটা কিছুটা হলেও খারাপ করেছি। ওকে বলে আসা উচিৎ ছিল। কেন যেন বলে আসার কথা স্বরণে আসেনি। ফোন রিসিভ করে কি বলবো বুঝতে পারছি না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রিংটোন থেমে গেল। রিসিভ করা হলো না। আবার কল আসার অপেক্ষা করলাম। রিং এলো না। আমি কল ব্যাক করতে ইচ্ছে হলেও কেন যেন করা হয়ে উঠল না। খানিক্ষণ একাকী হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর এগিয়ে গেলাম। পুনরায় মোবাইল বাজলো। ভাবলাম মিতুই হবে। কিন্তু হলো না। আসলে ভাবনারা এমনই হয়। ফোন করেছে পারুল। রিসিভ করলাম।
– হ্যালো পারুল।
– তুমি কোথায় ভাইয়া?
– আমি তো অনেক দূরে!
– হেঁয়ালি রাখো। কোথায় তুমি ঠিকঠাক বলো। খুব দরকার!
– কেন রে? কি হলো?
– আরে রুমি এসেছে আমাদের বাড়িতে। কোথায় তুমি?
– ও আচ্ছা। সত্যি সত্যি আমি অনেক দূর। ওকে বলো রাত এগারোটায় পুকুর পাড়ে আম তলায় চলে আসতে। কথা আছে খুব…!
– তা সম্ভব নয়। ওই আমতলা একান্তই তোমার আমার। ওখানে কেউ ভাগীদার চাইনা আমি।
– তাহলে কি হবে?
– রুমির সাথে তাহলে তোমার আর আজকে দেখা হচ্ছে না। আজ তুমি আমার সাথে…!
– তুই যেমনটা ভালো বুঝিস তাই হবে।
– রুমিকে বলে দিলাম কালকে রাতের কথা তাহলে?
– আচ্ছা
– তোমার বাসায় আসতে কতক্ষণ লাগবে?
– দূর যেহেতু অনেক, ফিরতেও অনেকক্ষণ লাগা উচিৎ।
– যতটা পারো তাড়াতাড়ি আসতে চেষ্টা করো।
– আচ্ছা দেখি।
আমি আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমি আর আমার অনেক অনেক ভাবনা হাঁটছি আর হাঁটছি….!
এটাই সত্য – একটা সময় সবাইকে ই ফিরতে হয়। আমিও এবার ফিরতে চাই। পেছন ফিরে হাঁটতে উদ্যত হলাম। অনেকদিন পরে মনে পড়ল রোকসানার কথা। রোকসানার নরম কচি মুখখানা হৃদয়ে জাগতেই কেমন বুকের মধ্যে  মুচড়ে উঠলো। রোকসানা কি আমাকে ক্ষমা করেছে? করবেই বা কিভাবে? আমি কি ক্ষমা চেয়েছি ওর কাছে? আসলে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটা ই বা পেলাম কই? রোকসানার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আমার। ও কি আমাকে ক্ষমা করবে? করুক বা না করুক ক্ষমা ভিক্ষা আমাকে করতেই হবে। নারী হৃদয় কোমল হয় শুনেছি। হয়তো ও আমাকে ক্ষমা করে দেবে! আচ্ছা রোকসানার কথা মনে এলেই আমি এমন কেমন কেমন হয়ে যাই কেন? তবে কি আমি ওকে…! কি ভাবছি আমি এসব? আমিতো ভালোবাসি মিতু কে। সত্যি কি আমি মিতুকে ভালোবাসি? পারুল আমার কে? রুমি?
উফফফ……!

১৬.
রাত এগারোটা। এই সময় আমার পুকুর পাড়ে আম তলায় থাকার কথা। ইচ্ছে করছিল না যেতে। ইচ্ছে করল কিছুক্ষণের মধ্যেই। গেলাম। পারুল আজ অপরুপ করে সেজেগুজে এসেছে। আমার ভালো লাগলো। ওর কাছে পৌঁছালে ও বেশ আনন্দিত হলো বোধয়। আনন্দ পেলে মানুষের মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ে। এর বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও আছে নিসন্দেহে। তবে সেই যুক্তি আমার জানা নেই। জানা থাকা উচিৎ ছিল। আমার ওতো মুখে এমনটা ঘটে। তবে জানা থাকা দরকার ছিল না আমার?
যাইহোক। কতকিছুই তো জানি না আমরা! এমনকি জানতেও চাই না। এমনকি জানতে হয় সেটাও জানি না আমরা। ইচ্ছা থাকলে হয়তো যেকোনো প্রকারে জেনে যাওয়া যেতো হয়তো।
– কয়টা বাজে?
ঘড়ি নেই হাতে। আনুমানিক বললাম
– সাড়ে এগারোটা হবে হয়তোবা।
– এত দেরি করলে কেন?
– আসলে ইচ্ছে করেই দেরি করেছি। পরিক্ষা করলাম তোমার ধৈর্য্য কেমন।
– আমাকে পরিক্ষা করার প্রয়োজন অনুভব করো তুমি?
– আসলে বিষয়টা একটু অন্যরকম। মাঝে মাঝে সত্যকেও মিথ্যা মনে হয়। আর তখনি প্রয়োজন হয় তুচ্ছ মিথ্যের আশ্রয়। আর মাঝে মাঝে মিথ্যেকেও সত্য মনে হয়। আর তখনি প্রয়োজন হয় উন্নত সত্যের প্রত্যাখ্যান। আসলে বিপরীত বিষয়টা থাকেই থাকে। তা হোক সে উপযোগ অথবা অনুপযোগ।
– তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝিনা আমি। আমাকে একটু সহজ করে বলতে পারো না অভি?
– পারি। রুমিকে কি বল্লে?
– ওর প্রসঙ্গটা এখন না হয় থাক। কাল ওর সাথে কথা বলেই না হয় জেনে নিও সবকিছু।
– আচ্ছা।
– একটা সত্য কথা বলবে অভি?
– কি জানতে চাও বলো!
– আগে বলো সত্য বলবে!
– আচ্ছা বলবো।
– তুমি কি আমাকে মোটেও পছন্দ করো না অভি?
কি বলবো বুঝতে পারছি না।  বললাম
– তুমি কি অপছন্দ করার মতো?
– মোটেও না। তবে এটা ওতো সত্য যে- পছন্দ জনে জনে ভিন্নতা থাকতেই পারে।
– সেটা পারে। একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলো তো, আসলেই তুমি কে যে কারো অপছন্দের মতো হতে পারো?
– আমার তো মনে হয় না।
– তাহলে আমার কাছে নতুন করে কি জানতে চাও বলো? কি বলবো আমি?
– আচ্ছা থাক। তোমাকে বলতে হবে না কিছু। আসলে আমারই ভুল হয়েছে। কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যা প্রায়শই আমাদের হৃদয়ে জাগে। আর আমাদের উচিৎ ওই সব কিছু কিছু প্রশ্ন কে প্রতিবারই প্রতিহত করা।
– ঠিক। চলো। মাঠ ভর সারারাত চাঁদের আলোয় ভিজবো আমরা আজ।
(চলবে)