পঞ্চ পাণ্ডব


প্রকাশের সময় : জুন ১৩, ২০২২, ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ / ৪৩৯
পঞ্চ পাণ্ডব

নীতা কবি মুখার্জী

ঋজুর কাছে এই নিয়ে ছয় বার এলো ফোনটা।  হ্যাঁ,  বারে বারে ফোন বেজে চলেছে। যতবার ধরতে যায়, শুধু শ্বাস নেওয়ার আওয়াজ। কোনো কথা নেই। আশ্চর্য! কে এমন করছে? কেনই বা করছে ? কি বলতে চাইছে ঋজুকে?
যে ঘটনার কথা বলছি সেটা ঘটেছে প্রায় কুড়ি বছর আগে। তখন ঋজুর বয়স বছর বারো। ওর দিদিকে ধর্ষণ করে খুন করে একদল ধর্ষণকারী দুর্বৃত্ত ঋজুর দিকে এগিয়ে আসে ওকে শেষ করে দিতে।
ঠিক সেই সময়ে গোরা ঘোষের পাঁচটি কুকুর খোলা অবস্থায় ছিলো এবং বিপদ বুঝে ধর্ষণকারীদের দিকে তেড়ে আসলে ওরা প্রাণপণে পালায়।
ঋজু সে যাত্রায় রেহাই পায়।
হ্যাঁ ,গোরা ঘোষ হলো একজন গুণ্ডা টাইপের লোক , পাড়ার সবাই ওকে ভয় পায়। গোরা ঘোষ গুণ্ডাগিরি করলেও সমাজের অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার সবসময় চোখ কান খোলা রাখতো আর পুষেছিল পাঁচটি বাঘা কুকুর, যাদের দেখে সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো।
ঋজুর দিদি খুন হওয়া এবং ঋজু এটেম্পট টু মার্ডার হওয়াই ঋজুর বাবা ভয়ে গ্ৰাম ছেড়ে চলে গিয়ে অন্যত্র বাড়ী কিনে থাকতে শুরু করেন।
গ্ৰাম ছেড়ে চলে আসার সময় গোরা ঘোষের সাথে দেখা করতে গেলে গোরা ঘোষ বলেছিল, “ঋজু আর কিছু করিস না করিস গোটা পাঁচ ছয় কুকুর পুষবি।  মানুষের চেয়ে বেশী কাজ দেবে।”
ঋজু বর্তমানে পুলিশের একজন নামকরা দুঁদে অফিসার। কাজকর্ম করে, সবই ঠিক আছে, ছোটবেলার অনেক স্মৃতি ভুলে গেছে। নতুন জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মিলিত হয়েছে।  কিন্তু ভুলতে পারেনি সেই ঘটনা, সেই মুখ , দিদির ধর্ষণ এবং খুনের প্রধান নায়ক সৈফুদ্দিন মিঁয়াকে। তার গালে ছিল একটা লম্বা সেলাইয়ের দাগ।
পুলিশের বড়বাবু হওয়ার সুবাদে গোরা ঘোষের পরামর্শ মতো পাঁচটি বাঘা কুকুর পুনেতে, নাম দিয়েছে পঞ্চ পাণ্ডব। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল,  সহদেব। রোজ রাত্রে কুকুর নিয়ে এলাকায় টহল দেয়। সকলে ঐ বাঘা কুকুরগুলোকে দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে।
এই ভাবে টহল দেওয়া, পুলিশের সরকারী কাজ,সবই ঠিকঠাক চলে কিন্তু ওর চোখ দুটো খুঁজে বেড়ায় সেই গালে কাটা দাগওয়ালা লোক।
একদিন রাত তখন সাড়ে বারোটা। এলাকার দাগী আসামীদের ফাইলপত্র দেখতে ব্যস্ত। এমন সময় ফোন আসে। এই ফোন আজ কয়েকদিন ধরে ঠিক রাত সাড়ে বারোটায় আসছে। কল হচ্ছে, জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর নেই। ঋজু বুঝতে পারে যে তার শিকার আস্তে আস্তে তার দিকেই এগোচ্ছে। অন্য দিন দু একবার করে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আজ ছয় বার বাজলো। ফোন ধরলে কোনো উত্তর নেই। শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ। ঋজু চিন্তা করতে লাগলো তাহলে কি সেই সৈফুদ্দিন মিঁয়াও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এতোদিন ধরে?
ঠিক তাই। শত্রুর শেষ রাখতে নেই ভেবে সেই সৈফুদ্দিনও হন্যে হয়ে এতোদিন ঋজুকে খুঁজে শেষে নাগাল পেয়েছে।
আজো রাত সাড়ে বারোটা। ফোন বাজতে থাকলো। সাড়াশব্দ নেই। শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ। কিন্তু আজ রাখার আগে খড়খড়ে গলায় একটা ঠিকানা দিয়ে বললো এখানে একবার দেখা করলে আপনার অভীষ্ট পূরণ হবে।
অসীম সাহসী ঋজু নিজের গুলি ভর্তি রিভলবার আর পঞ্চ পাণ্ডবকে নিয়ে পুলিশের জিপ নিয়ে সেই অজানা ঠিকানার দিকে এগোতে লাগলো। নিঝুম, নিস্তব্ধ, শ্মশানের কাছে এসে দেখলো একটা লোক টর্চ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে এসে বললো, বাবু, চলুন, ওদিকে। আপনার বিশেষ বন্ধু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কুকুরগুলো ট্রেনিং প্রাপ্ত ,তাই নিশ্চুপ হয়ে গাড়ীর মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলো, কেউ টেরও পেল না যে গাড়ীতে পঞ্চ পাণ্ডব আছে।
সামনে যেই আসা পুলিশের টর্চ মেরে দেখতেই ঋজু চমকে উঠলো। একি! এতো সৈফুদ্দিন! সেই গালে কাটা দাগটা দগদগ করছে। রাগে, ঘৃণায়, উত্তেজনায় ঋজুর শরীর দুলে উঠলো। সৈফুদ্দিন তার অপারেশন চালাবার আগেই ঋজু পঞ্চ পাণ্ডবকে ইঙ্গিত দিলো। সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডব সৈফুদ্দিনের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। সে আর পালাবার মতো অবস রইলো না। ফোর্স এলো।
বিচারের রায়ে সৈফুদ্দিনের যাবজ্জীবন জেল হলো। সেই রাতেই বড় দীঘিতে স্নান সেরে পঞ্চ পাণ্ডবকে নিয়ে দিদির স্মারকবেদীতে ফুল মালা, চোখের জল দিয়ে শোক জ্ঞাপন করলো এতোদিন পর…..