ধারাবাহিক উপন্যাস, জলে ও আগুনে : চতুর্থ অংশ


প্রকাশের সময় : আগস্ট ২৪, ২০২২, ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ / ৭০৬
ধারাবাহিক উপন্যাস, জলে ও আগুনে : চতুর্থ অংশ
ধারাবাহিক উপন্যাস: চতুর্থ অংশ
১৭.

টুম্পা একটা কেলেংকারী ঘটিয়ে ফেলেছে। আমি কখনও এমনটা ভাবতেও পারিনি যে বোন আমার এতোটা বড় হয়ে গিয়েছে। আমি কিছুটা মেনে নিতে চেষ্টা করলেও মা বাবা এমন ঘটনাটা কিছুতেই মানতে পারছেন না। বাবার এক কথা- এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব! মা পড়েছেন দোটানায়। না পারছেন গিলতে, না পারছেন ফেলতে। এমতাবস্থায় ভাই হিসাবে আমি বড়ই নিরুপায়! যদিও আমিও বিষয়টা ঠিকঠাক মানতে পারছি না তবুও বড় ভাই হিসাবে দ্বায়িত্বের একটা বিষয় থেকেই যায়। দ্বায়িত্ব! সে এক অদ্ভুত ভাবনার বিষয়। পায়ে বাঁধা শেকল কাটলে মানুষ স্বাধীন হতে পারে। আর মুক্ত পায়ে শেকল পরাতে পারলেই তাকে বলা হয় দ্বায়িত্ববান। আমারও ঘটেছে তেমন। টুম্পাকে ক’দিনের জন্য বাইরে কোথাও বেড়িয়ে আনতে হবে ভাবলাম। তাহলে হয়তো টুম্পার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু সেটা কোথায় হতে পারে ভেবে উঠতে পারছিলাম না। পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো ওকে আর মা কে দিয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে পাঠাবো। আর এর মধ্যে হাবিবের সাথে দেখা করে ওকে বিষয়টা বোঝাতে চেষ্টা করবো যে- তোমরা যেটা করেছো সেটা ঠিক নয়। রীতিমতো অন্যায় সেটা। এমনকি তোমাদের ভবিষ্যৎ ও নষ্ট হতে পারে যদি তোমরা ওপথ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারো। আমি তোমাদের পক্ষে আছি। তবে শর্ত এই যে- আগে তোমরা যে যার মতো করে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে নাও তারপর তোমাদের বিষয়টা দ্বায়িত্ব নিয়ে আমি দেখবো কথা দিলাম।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মা আর টুম্পা কে পাঠিয়ে দিলাম মামার বাড়ি। বাড়িতে আছি আমি আর বাবা। অসুবিধে বেশখানিকটা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে এমন অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় আমাদের। এভাবে ক’দিন কেটে গেল। এরপর একদিন হাবিবের সাথে দেখা করলাম। খোলামেলা আলাপ করলাম ওর সাথে। হাবিব “আচ্ছা আচ্ছা ” শব্দে মেনে নিল আমার সব কথা। আমি বিষয়টাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না আসলে এটা নেগেটিভ ডেসক্রিপশন নাকি পজিটিভ। তবুও সময়ের সাথে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব বটে। সবকিছু সময়ের উপর ছেড়ে বাড়িতে এসে বাবাকে মামা বাড়ি পাঠাবো টুম্পা আর মা’কে বাড়িতে আনতে ভাবলাম।

১৮.
হাবিব আর টুম্পা এক কলেজে পড়ে। ওদের চেনা জানা হয়েছে খুব বেশিদিন নয়। মাস ছয়েকের মতো। এর মধ্যেই ওদের ঘনিষ্ঠতা যতোটা ঘটেছে ততোটা ঘটা উচিৎ হয়নি। টিনএজ এমন-ই হয়। জীবনকে না জেনেই অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে এমন এমন ভাব! অথচ বয়স যতো বাড়তে থাকবে, বাস্তবতা চিনতে চিনতে তারপর অনেক কিছু বুঝে-ও আর বুঝা হয়ে ওঠে না।
হাবিব টুম্পা কে ঠকাবে নাকি আসলেই ওকে সমস্তটা জীবনের সঙ্গী করবে সেটা আমার বোধগম্য নয়। আমি নিজেই যেখানে নিশ্চিত করে নিজেকে সামলাতে পারি না সেখানে নিজের বাইরে আর কার কথা কি করে বুঝবো। আমি কেবল আমার মতো করেই জগতটাকে জানি। মানুষ এমনই। বিশ্বাসীর কাছে বিশ্বাস সম্পদ বটে, আর অবিশ্বাসীর কাছে সেটা দায়। আমি আমার জায়গা থেকে আমার দ্বায়িত্ব পালন করতে পারি মাত্র। যেটা আমার করা একান্তই উচিৎ! আমি টুম্পা ও হাবিবের বিষয়ে নিজেকে চিনতে পারছি খুব ভাবে। আমি অন্যের সাথে যে অপরাধ করছি সেইরূপ আমার সাথেও ঘটবে এটা অবসম্ভাবি। অথচ তবুও আমরা অপরাধ ঘটিয়ে থাকি নিজের অজান্তে হলেও। আসলে প্রকৃতি বড়োই অদ্ভুত! সে চলে আপন নিয়মে, আপন গতিতে। সামনে যা-কিছু থাক তা সকলই নিমিষেই চলে যায় প্রকৃতির দখলে। আমরা কেবল তাকিয়ে দেখি যা-কিছু দেখার, আর শুনতে থাকি যা-কিছু শোনার। প্রকৃতির কাছে প্রকৃতই মানুষ নিরুপায়, অসহায়!

১৯.
তমা আমাকে কিছু বলতে চায়। মিতু বারবার তমার কথা এলেই কেমন চমকে ওঠে। আমি কিছুই আন্দাজ করতে পারি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি যে বিষয়টা বেশ জটিল। আজ বিকেলে তমা আমাকে নদীর পাড়ে একাকী দেখা করতে যেতে বলেছে। বিষয়টা মিতু যেন না জানে বারবার বলে দিয়েছে তমা। আমি মোবাইলে যতটা বিনীত হওয়া সম্ভব কি বলবে সেই বিষয়টার শিরোনাম অন্তত জানতে চেষ্টা করেছি। তমার এক কথা। সাক্ষাতে বলবে। তবে মিতু যেন কিছুই না জানে। এমনটাই প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে তমা আমাকে দিয়ে। বিষয়টা আমাকে খানিকটা ভাবিয়ে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। ভাবতেও হচ্ছে বেশ। বিকেলের প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছিলাম। এমন সময় মা এলো আমার কামরায়।
– কি করছিস অভি?
– তেমন কিছুই না মা। বলতে পারো বিশ্রাম।
– আমার একটা কথা শুনবি বাবা?
– কান তো খোলাই আছে মা। বললেই হড়হড় করে ঢুকে পড়বে।
– হেয়ালি রেখে শান্ত ভাবে শোন আমার কথা বাবা!
বিছানায় গড়াগড়ি ছেড়ে সোজা হয়ে বসলাম। মা’কে বললাম- বলো এবার!
– টুম্পা কে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
– কি বলো এসব মা?……!
– থাম তুই। আমি যা বলি মন দিয়ে শোন অভি। তোরা এখনও ছোট-ই বটে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখেছি, যা শিখেছি, সেটাই বলছি তোকে। টুম্পাকে বিয়ে দিতেই হবে! আর আমার কথা যদি অমান্য করিস তাহলে তার পরিনাম খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।
– কিন্তু তাই বলে ওর ভবিষ্যতের কথা তুমি একটুও ভাববে না মা?
– যা ভাবার সবই ভেবেছি আমি। আমার কথা শোন অভি! টুম্পা হাবিবের সাথে খুব গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েছে এটা তোর অজানা নেই নিশ্চয়ই?
আমি মায়ের এই কথার কিছুই উত্তর দিতে পারলাম না। কেবল মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
মা বল্ল-
কই? কিছু ইতো জবাব নেই তোর। বাস্তবতা এমনই বাবা, মাথা নিচু হবার কিছু ঘটে গেলে সেটা যতোই স্বাভাবিক ঘটনা হোকনা কেন মাথা তুলে সত্যকে গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে খুবই অসম্ভব! আমি যেটা বলছি সেটাই আদেশ জ্ঞান করবি সেটাই আশা করছি আমি। অযথা তর্ক বাড়াবি না এটাই আশা করছি আমি। আর টুম্পার ভবিষ্যতের কথা বলছিস তো? ওটা মা বাবার চেয়ে দ্বায়িত্বের সাথে আর কেউই চিন্তাও করতে পারে না বাবা। যদি ওকে এখন সুপাত্রে পাত্রস্থ করতে না পারি তাতেই ওর ভবিষ্যত খারাপ হবে। আর হাবিব ছেলেটা ধরে নিলাম খারাপ না। তাতেও কোন সুফল নেই। হাবিবের ভবিষ্যতে কি হবে না হবে সেটা সকলেরই অজানা। তবে নুন্যতম এটুকু আন্দাজ করছি যে- যে ছেলে নিজের ভবিষ্যত গড়ার চেয়ে অন্য কোন উন্মাদনায় মত্ত হতে বেশি পছন্দ করে তার ভবিষ্যৎ খুব বেশি ভালো হবে বলে মনে হয় না আমার কাছে।
মায়ের কথা কেবল শুনতেই লাগলাম। কিছুই উত্তর খুঁজে পেলাম না। মা কেবল বলেই চলেছে-
– শোন বাবা অভি। টুম্পা কে যদি ভালো কোন ছেলের হাতে তুলে দিতে পারি তাহলে হয়তো ওরা ওর  পড়ালেখাটাও চালিয়ে নেবে। তাতে করে টুম্পার ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার সম্ভাবনা ও বিলুপ্ত হচ্ছে না নিশ্চই? আর অমন সুন্দর কাউকে সঙ্গী হিসাবে পেলে ক’দিন যেতে না যেতেই হাবিব কে ভুলে যাবে টুম্পা এটাই স্বাভাবিক। একেই বলে বাস্তবতা বাবা। হয়তো এ কথা নিষ্ঠুর কথা বলে মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর বাবা। আমার কথা উপদেশ জ্ঞানে মেনে নে অভি! তুই বিকেলেই আমার বাল্যবন্ধুর আসাদের সাথে দেখা করতে বাজারে যাবি! আসাদ আজ আমাদের বাজারে তার কি এক ব্যবসায়ীক কাজে আসবে। আমি ওকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ওর ব্যস্ততার জন্য আসতে পারবে না। ওর পরিচিত একটা ছেলে আছে। রাজস্বে চাকরি করে। ছেলে দেখতে শুনতে খুবই ভালো। সম্পদশালীও খুব। বনেদী পরিবার। এমন ছেলে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিনা আমি। তাছাড়া টুম্পাকে পড়িয়েশুনিয়েও এর চেয়ে ভালো ছেলে পাবো বলে বিশ্বাস হয়না আমার। তুই অবশ্যই বিকেলে আসাদের সাথে দেখা করবি এটাই আমার শেষ কথা।

মা বেরিয়ে গেল আমার রুম থেকে। আজ বিকেলে তমার সাথে নদীর পাড়ে দেখা করার কথা আমার। তমা আমাকে কিছু বলতে চায়।
(চলবে)