মরেও দায়মুক্তি পেলেন না মাঝি,জনমনে ধুম্রজালের সৃষ্টি


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৮, ২০২২, ৫:১৪ অপরাহ্ণ / ১৯০
মরেও দায়মুক্তি পেলেন না মাঝি,জনমনে ধুম্রজালের সৃষ্টি
মাজহারুল ইসলাম পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ-
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায়  ইজারাদারদের ও ওই নৌকার মাঝিকে দায়ী করে গোপনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। রবিবার (২ অক্টোবর) রাতে জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলামের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটির প্রধান জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর কুমার রায়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানানো হয়নি জেলা প্রশাসন। এমনকি জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি গোপন রেখেছেন। সোমবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মৃতদের পরিবারের মাঝে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল। ওই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটি।’
এ সময় সাংবাদিকরা তদন্ত প্রতিবেদনের কপি চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনের কপি আপনাদের দেওয়া যাবে না। এটি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।’
মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক,‘তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার চারটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—দুর্ঘটনার জন্য ঘাটের ইজারাদারকে দায়ী করা হয়েছে, নৌকার মাঝির অদক্ষতা ছিল, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে ভেবে যাত্রীদের নিষেধ না করা এবং অসচেতনতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি ভৌগলিক পরিস্থিতি ও নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন-জীবিকার কথা উল্লেখ করে ১১৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পাঁচ দফা সুপাারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।’
এদিকে, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখা এবং ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মৃতদের স্বজন ও স্থানীয়রা। এলাকার অভিজ্ঞমহল ও স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবী হাজার হাজার মানুষের সম্মুখে নৌকা দুর্ঘনায় ৬৯ জনের প্রাণহানী ঘটল কিন্তু এতবড় একটি দুর্ঘটনায় তদন্ত করা হলো গোপনে এ বিষয়ে সবার মনে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা বলেন, শুধু কি ইজারাদার ও নৌকার মাঝিই দায়ী? তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন,ঘটনাস্থলে পুলিশ প্রশাসন,ফায়ার ডিফেন্সের সদস্যরা, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন ছিল তারা ৫০ জনের অতিরিক্ত লোকজনের উর্ধে লোকজন না উঠার কড়া নির্দেশ প্রদান করলে এবং জেলা প্রশাসন আরো নৌকার ব্যাবস্থা করলে এ দুর্ঘটনা এড়াতে পারত। এ দুর্ঘটনার দায়বদ্ধতা তাঁদেরও উপর বর্তায় বলে অনেকে অভিযোগ তুলেছেন। এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক কি আছে তদন্ত প্রতিবেদনে, কারা দোষী এবং তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে—বিষয়টি সবাইকে জানানো দরকার। গনমাধ্যমের কর্মীরা তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর কুমার রায় বলেন, ‘১১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে নৌকার মাঝি, ইজারাদার ও দায়িত্বশীলদের দায়ী করা হয়েছে।’
 জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবেদনটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে এ ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে, তারা যে নির্দেশনা দেবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।তবে নৌকাডুবির ঘটনাকে নানা জনে নানাভাবে উপস্থাপন করছেন। ঘাটের ইজারাদারের গাফিলতি, সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, মহালয়ার অনুষ্ঠানে অনেক ভক্তের উপস্থিতি ঘটবে, এটা আগে থেকেই সবার জানা। তারপরও নদী পারাপারের জন্য ঘাটে একাধিক নৌকা না থাকা, নৌকায় ওঠানামার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঘাট স্থাপন না করা, বাঁশের বেড়া দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা না করা, অতিরিক্ত ভিড়ে মাত্র একজন করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মোতায়েন করা, স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত না করা, অতিরিক্ত যাত্রী তুললে নৌকাডুবির আশঙ্কার বিষয়টি মাইকে প্রচার না করাসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বদেশ্বরী মন্দির কমিটির সভাপতি নীতিশ কুমার বকশী বলেন, ‌‘মহালয়া অনুষ্ঠানের আগে ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ছয়টি নৌকা ঘাটে রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ইজারাদার তা করেননি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও বাকি নৌকা না আসায় একটিতেই নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেন পুণ্যার্থীরা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘাটে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো। ঘাটে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও গ্রাম পুলিশের সদস্যদের আরও কঠোর হওয়া দরকার ছিল।মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু আনছার মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘জেলা পরিষদ এবং ইজারাদার দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। ঘাটের কোনও উন্নয়ন হয়নি। আমার ইউনিয়নের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই।’
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সানিউল কাদের বলেন, ‘স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইজারা ও ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী এসব ঘাট পরিচালিত হচ্ছে। নদীবন্দরগুলোর জন্য বন্দর পরিদর্শক ও নৌযানের ফিটনেস দেখার জন্য জনবল থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু এখানে কিছুই ছিল না। ঘাটগুলো কীভাবে চলবে, নৌযানগুলো কেমন হবে, কোন যন্ত্রের সাহায্যে চলবে, কতজন যাত্রী তুলতে পারবে, জনবল কাঠামো কেমন হবে—এসব নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি।’
জেলা পরিষদের প্রশাসক আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, ‘বরদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। সেখানে অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও ছিলেন। তারা মাঝিকে নির্দেশ দিলে এত যাত্রী উঠাতে পারতো না। এত মৃত্যুও হতো না। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে জেলা প্রশাসন।স্থানীয় সমাজকর্মী আব্দুল্লাহ আল জুবেরী বলেন, ‘মহালয়ার মতো বড় অনুষ্ঠানের জন্য যেমন সমন্বয় দরকার হয়, আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় ছিল না। দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।’
এদিকে, নৌকাডুবির ঘটনায় দশম দিনেও উদ্ধার অভিযান চলেছে। কিন্তু এখনও নিখোঁজদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বোদা উপজেলা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, ‘অভিযানে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি নেই। নিখোঁজ তিন জনের লাশ পাওয়া যায়নি। নদীর তলদেশে বালুতে লাশগুলো চাপা পড়তে পারে। এজন্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।’এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বোদা উপজেলার ৪৬, দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৭, আটোয়ারীর দুই, পঞ্চগড় সদরের এক এবং ঠাকুরগাঁও সদরের তিন জন। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৮, নারী ৩০ এবং শিশু ২১ জন। তিন জন নিখোঁজ রয়েছেন।তারা হলেন—দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর হাতিডুবা গ্রামের মদন চন্দ্রের ছেলে ভুপেন ওরফে পানিয়া, বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের খগেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন এবং পঞ্চগড় সদরের ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথের মেয়ে জয়া রানী।