সিমেন্ট শিল্পের সমস্যা সমাধানে দরকার সরকারের পদক্ষেপ


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১৩, ২০২২, ৬:২১ অপরাহ্ণ / ৮৯
সিমেন্ট শিল্পের সমস্যা সমাধানে দরকার সরকারের পদক্ষেপ

নিজস্ব প্রতিবেদক:-  কাঁচামাল আমদানিতে আকস্মিক সম্পূরক শুল্ক আরোপ ও অতিরিক্ত অগ্রিম করারোপ, জ্বালানি সংকট, পরিবহন ভাড়া ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানামুখী সমস্যায় দেশের সিমেন্ট শিল্প বর্তমানে দুরাবস্থার মধ্যে রযেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সিমেন্টের মূল্যের ওপর।

যা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমানে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমেই সিমেন্টে শিল্পের এসব সমস্যার সামাধান সম্ভব বলে মনে করেন সিমেন্ট শিল্প মালিকরা।

মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর গুলশান-২ এর হোটেল আমারি ঢাকাতে বাংলাদেশ সিমেন্ট শিল্পের বর্তমান চিত্র তুলে ধরা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির।

লিখিত বক্তব্যে মো. তিনি বলেন, ‘আড়াই দশক আগে সিমেন্টের প্রায় সম্পূর্ণ চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হতো। কিন্তু গত আড়াই দশকে উদ্যোক্তাদের সাহসী পদক্ষেপ ও সরকারের নীতি সহায়তার কারণে সিমেন্ট শিল্প একটি বিকাশমান শিল্প ও তুলনামূলক সুসংগঠিত খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশেও সিমেন্ট রপ্তানি করে আসছে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান সিমেন্ট উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এর বার্ষিক কার্যকরী উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৭৯ মিলিয়ন টন। যার বিপরীতে চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন টন। চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুনের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা থাকার কারণে বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে নামমাত্র মূল্যে সিমেন্ট বিক্রি করতে হয়। এতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে আলমগীর কবির বলেন, সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামালগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল লাইমস্টোনের ওপর আকস্মিক ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়করের সঙ্গে আরও ২ শতাংশ অতিরিক্ত অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি লাইমষ্টোন আমদানিতে আগে থেকেই ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও ৩ শতাংশ অগ্রিম কর বিদ্যমান রয়েছে। লাইমষ্টোনের ওপর নতুন করে সম্পূরক শুল্ক ধার্যের কারণে এ খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, এই অতিরিক্ত উচ্চায়নের ফলে বর্তমানে আমদানি মূল্যের ওপর প্রায় ২৭ শতাংশের পরিবর্তে প্রায় ৬৭ শতাংশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করে লাইমষ্টোন ছাড় করাতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামাল হলো ক্লিংকার, প্লাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাইঅ্যাশ এবং জিপসাম। এই পাঁচ কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এখানে আরও উল্লেখ করা যায় যে, বিএসটিআই এবং ইউরোপিয়ান নর্মস অনুযায়ী সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত লাইমষ্টোন ব্যবহারযোগ্য। লাইমষ্টোনের আমদানি মূল্য অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি মূল্যের তুলনায় সবচেয়ে কম। সে কারণে লাইমস্টোন সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী একটি কাঁচামাল, তাই এই অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে, সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা লাইমষ্টোন আমদানিতে নিরুৎসাহিত হবেন। এতে বর্তমান ডলার সংকটের ওপর অতিরিক্ত চাপ বাড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিসিএমএ প্রেসিডেন্ট বলেন, আমদানি পর্যায় ছাড়াও বিক্রয় পর্যায়েও ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করা আছে। অর্থাৎ একটি সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও তাকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে এই অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে সিমেন্ট শিল্পের জন্য অগ্রিম আয়করের কারণে দূরাবস্থার বিষয়টি আমরা সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা অতীতে বহুবার তুলে ধরেছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে দেশের একটি উদীয়মান শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন এবং অগ্রিম আয়কর আমদানি ও বিক্রয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ ০ দশমিক ৫০ শতাংশ ধার্য করবেন এবং চূড়ান্ত কর দায় থেকে মুক্ত করবেন।

ডলার সংকটের কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে এবং খরচ বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে নতুন করে এলসি খুলতেও বর্তমানে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন সিমেন্ট শিল্প মালিকরা। লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্যাস সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সিমেন্টের স্থানীয় পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। এছাড়া সিমেন্ট রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকাতেও এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আলমগীর কবির বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যদি এই খাতটিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করে, ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়; তাহলে সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের এই দুরাবস্থা কিছুটা হলেও কমবে এবং দেশের সিমেন্ট শিল্প প্রসারিত হবে।

তিনি বলেন, আমরা লাইমস্টোনের ওপর সম্পূরক শুল্ক জরুরি ভিত্তিতে সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছি। অগ্রিম আয়কর আমদানি এবং বিক্রয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ ০ দশমিক ৫০ শতাংশ ধার্য করা এবং এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কর দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

লাইমষ্টোনের ওপর ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ: সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা দীর্ঘদিন ধরেই এইসএস (HS) কোড ২৫২১ দশমিক ০০ দশমিক ১০ এর আওতায় লাইম স্টোন আমদানি করেন। ৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (CD), ১৫ শতাংশ ভ্যাট (VAT), ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (AIT) এবং ৩ শতাংশ অগ্রিম কর (AT) দিয়ে শুল্কায়ন করে আসছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাষ্টমস্ হাউস কর্তৃপক্ষ আগের এই এইচএস কোড পরিবর্তন করে নতুন এইচএস কোড ২৫১৭ দশমিক ১০ দশমিক ৯০ উল্লেখ করে ৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৩ শতাংশ অগ্রিম কর ধার্য করে শুল্কায়ন করছে। ফলে বর্তমানে সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে বর্তমানে আমদানি মূল্যের ওপর প্রায় ২৭ শতাংশের পরিবর্তে প্রায় ৬৭ শতাংশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করে লাইমস্টোন ছাড় করাতে হচ্ছে।

সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালে অগ্রিম আয়কর আরোপ: বর্তমান সরকার কর্তৃক সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের আমদানি পর্যায় চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে বিবেচনা করছে সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা। ক্লিংকার ২ শতাংশ, স্ল্যাগ ১০ শতাংশ, লাইমস্টোন ৫ শতাংশ, ফ্লাই অ্যাশ ৩ শতাংশ, জিপসাম ৫ শতাংশ। এছাড়াও বিক্রয় পর্যায়ে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করা হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও, শুধুমাত্র চূড়ান্ত কর দায়ের কারণে, তাকে অগ্রিম আয়কর দিতে হচ্ছে। যা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। সিমেন্ট খাতের বিনিয়োগকারীরা (অর্থাৎ শেয়ার হোল্ডাররা) প্রশ্ন তুলছে যে লোকসান হচ্ছে, কিন্তু কীভাবে এআইটির মাধ্যমে আয়কর দিচ্ছেন। সরকার অনুমোদিত প্যানেল অডিট প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষার পর লোকসান প্রদর্শিত হলেও এআইটির মাধ্যমে আয়কর দিতে হচ্ছে। এই অবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। উপরোক্ত সম্পূরক শুল্ক এবং অগ্রিম আয়কর ধার্যের ব্যবস্থাটি সরকারের শিল্প বান্ধব নীতির পরিপন্থী। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না, যার ফলশ্রুতিতে দেশের একটি উদীয়মান শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ডলার সংকটে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি বিঘ্নিত: সিমেন্ট একটি আমদানি নির্ভর শিল্প। এই শিল্পের ৫টি কাঁচামাল- ক্লিংকার, প্লাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাইঅ্যাশ এবং জিপসাম আমদানি করতে হয়। সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা সাধারণত বিলম্বে পরিশোধযোগ্য ঋণপত্রের মাধ্যমে আমদানি করে থাকেন। চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রতি ডলারের দাম ৮৬-৮৭ টাকা বিবেচনায় নিয়ে আমদানি করে এবং প্রায় এক-দুই মাসের মধ্যে এই বিনিময় হার ধরেই স্বাভাবিক লাভ হবে প্রত্যাশা করে, সিমেন্ট বিক্রি করে দেয়। পরে প্রায় ৬/৭ মাস পরে যখন আমদানি বিল পরিশোধের সময় আসে, হঠাৎ ড্রপারের বিনিময় হার হয়ে যায় ১০৬-১১২ টাকা। যা সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের কাছে অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থার কারণে সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা বলতে গেলে, প্রায় ২০ শতাংশ মূলধনী লোকসানের মুখে পড়েছেন। একই কারণে অর্থাৎ ডলারের মূল্য বেশি হওয়ার কারণে প্রায় ২০ শতাংশ ও বেশি ব্যাংক ঋণ লাগছে। এতে চলতি খরচ ও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।

এছাড়াও নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রেও বর্তমানে বিরাট বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। একটি আমদানি চালানকে কয়েকটি ছোট ছোট ভাগ করে, অনেক বাধা পেরিয়ে কোনো কোনো উৎপাদনকারী ঋণপত্র খুলতে পারছেন এবং বাজারে সিমেন্ট সরবরাহ বজায় রাখার চেষ্টা করছে। আবার অনেক ছোট ছোট উৎপাদনকারীরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও ঋণপত্র খুলতে পারছে না।

সরকার যদি এই খাতটিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করে এবং ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়, তাহলে সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের এই দূরাবস্থা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস স্বল্পতায় উৎপাদন বিঘ্ন: সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কোনো কোনো উৎপাদনকারী নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকলেও, গ্যাস সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না এবং ফলশ্রুতিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের নির্মাণ শিল্পের স্বার্থে সরকার যদি সিমেন্ট শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা করে, সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা এই চলমান সংকট থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবে।