পঞ্চগড়ের সমতলভূমির চা চাষ এখন নীলক্ষেতে পরিণত হতে যাচ্ছে


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২, ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ / ৫৮২
পঞ্চগড়ের সমতলভূমির চা চাষ এখন নীলক্ষেতে পরিণত হতে যাচ্ছে
মাজহারুল ইসলাম পঞ্চগড়  প্রতিনিধিঃ পঞ্চগড়ের  সমতলভূমির চা দেশব্যাপি সুনাম অর্জন করলেও বর্তমানে কতিপয় ব্যাক্তি, গোষ্ঠি ও কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে চাষীদের চা পাতা প্রতি কেজি দর দেয়া হচ্ছে মাত্র ১২/১৪ টাকা দরে।ফলে চা চাষীদের প্রচন্ড লোকসান এবং শ্রমিকদেরও হাজিরা কমে দাড়িয়েছে মাথাপিছু ৩শত টাকায়। চা উৎপাদনের সূচনালগ্নে কাচা চা পাতা প্রতি কেজি দর ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এখন তা নেমে দাড়িয়েছে ১২ টাকায়।এর ফলে চা চাষীরা চা চাষ থেকে এখন বিকল্প ক্ষেত সুপারি মালটা ও আম বাগানের পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।
দেশের উত্তর জনপদের পঞ্চগড়ে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর পঞ্চগড় অন্যতম চা অঞ্চল হিসেবে এরই মধ্যে দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।পঞ্চগড় ইতোমধ্যে দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। একসময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি ও দেশের সবচেয়ে অনুন্নত জেলা পঞ্চগড় এখন চায়ের সবুজ পাতায় ভরে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য। দেশের বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে পঞ্চগড়ের চা। এখানকার অর্গানিক চা বিক্রি হচ্ছে লন্ডনের হ্যারোড অকশন মার্কেটে। রপ্তানি হচ্ছে দুবাই, জাপান ও আমেরিকায়। এ বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ লাখ কেজি। চা বোর্ডের ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট পান ফর টি ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশ ভিশন-২০২১’ প্রকল্প গ্রহণ করায় এখানকার চাষিদের মধ্যে চা উৎপাদনের আগ্রহ বেড়ে গেছে। তেঁতুলিয়া থেকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। আর এখানে উৎপাদন হচ্ছে পৃথিবীর সেরা চা। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেন। অতঃপর ওই সময়ের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেনের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ করা হয়। প্রথমে টবে, পরে জমিতে চায়ের চাষ করা হয়। সে সফলতা থেকে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদন করা হয়। ২০০০ সালের দিকে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি ও কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান চা চাষ শুরু করে। কয়বছরের মধ্যেই তেঁতুলিয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ গো-চারণ ভূমি চায়ের সবুজ পাতায় ভরে যায়। সৃষ্টি হয় সবুজের সমারোহ। চা বোর্ডের পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় এগিয়ে আসে স্থানীয় ক্ষুদ্র চা চাষীরা। বাগান মালিকদের পাশাপাশি তারাও চাষ করে চা। পঞ্চগড়ে নীরবে ঘটে চা চাষের বিপ্লব। পঞ্চগড় চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে জেলার ১৬ হাজার একর জমি চা চাষের উপযোগী রয়েছে। এ পর্যন্ত চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে দুই হাজার ২৫৫ দশমিক ৫৫ একর জমিতে। চা চাষ করছে ১৮২ জন স্মল গ্রোয়ার্স যার জমি ৫ একরের নিচে, ৫ থেকে ২০ একরের মধ্যে স্মল হোল্ডার্স ১১ জন এবং ২০ একরের ওপরে ১৯টি টি এস্টেট। এসব চা বাগানে প্রায় হাজার পাঁচেক নারী-পুরুষের কাজের সংস্থান হয়েছে। আগে যেখানে পুরুষ শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন আর নারী শ্রমিকরা পাথর ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন নারীদের কোমল হাত দিয়ে তোলা হচ্ছে দুইটি পাতা একটি কুঁড়ি। বিশেষ করে দরিদ্র ও বঞ্চিত নারীদের জীবনে দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা দিয়েছে।এ এলাকার চা চাষের বিশেষত্ব হচ্ছে কৃষকরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা বাগান গড়ে তুলছে। যা প্রান্তিক চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জেলায় চা চাষ হওয়ায় চাষিদের ৯ মাসের আয়ের পথ তৈরি হয়েছে।  স্থানীয় বেকার যুবদের কর্মসংস্থান ও জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।পাশাপাশি সবুজ বনায়ন,প্রাকৃতিক পরিবেশ,ভুমি ক্ষয়রোধ ও বন্য প্রাণী সহ অন্যান্য প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করণে বিশাল ভূমিকা রাখছে।নতুন প্রজন্মরা স্বপ্ন দেখছে হোম টুরিজম বিকাশ লাভ করবে আগামীর পঞ্চগড়।
বাগানগুলোকে কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া চা বাগান দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে পর্যটক। এতে জেলার চিত্র গত কয়েক বছর আগের তুলনায় পাল্টে গেছে কয়েক গুণ। বেড়েছে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ। সরকারি কোষাগারে যোগ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থের।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের মধ্যে চায়ের উৎপাদন ১০০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করা হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬১ কোটি টাকা। পঞ্চগড়ে চা চাষ প্রক্রিয়াজাত কারখানা আছে তিনটি। বর্তমানে আরও একটির নির্মাণ কাজ চলছে। চা চাষি মতিয়ার রহমান জানান, কৃষকদের প্রয়োজনীয় কীটনাশক, সারসহ কৃষি উপকরণ সহজশর্তে দেওয়া হলে চা চাষের পরিধি অনেক বাড়বে। তাছাড়া তিনি চা পাতার মূল্য বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড়স্থ আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, সরকারের পক্ষে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা, ভর্তুকি, ঋণের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক চাষিদের ঋণ সহায়তা দিচ্ছে।বোদা উপজেলার ক্ষুদ্র চা চাষী ও মানবাধিকার কর্মী আনিসুজ্জামান নতুন জানান,বর্তমানে চা পাতা নিয়ে বিরাজমান সমস্যায় কিছু ব্যাক্তি,, গোষ্ঠি ও কতিপয় কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট ও হীনস্বার্থ লিপ্ত রয়েছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে।এদের পায়তারা বন্ধ হলে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমির চা দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তজাতিক বাজারে প্রবেশ করবে নিঃসন্তেহে।