জাতীয় সংসদে উঠলো সাইবার নিরাপত্তা বিল ২০২৩


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩, ৯:৩০ অপরাহ্ণ / ৩০
জাতীয় সংসদে উঠলো সাইবার নিরাপত্তা বিল ২০২৩

স্টাপ রিপোর্টার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে সাইবার জগতের নিরাপত্তায়সাইবার নিরাপত্তা বিল, ২০২৩আইন করতে একটি বিল সংসদে উঠেছে।

মঙ্গলবার ( সেপ্টেম্বর) সংসদে বিলটি উত্থাপন করেন তথ্য যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পাঁচ দিনের সময় দিয়ে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। এর আগে স্পিকার . শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্ত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।

বিলটি উত্থাপনের শুরুতেই জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম আপত্তি জানিয়ে বলেন, অংশীজনরা এই বিলের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইনকে টিআইবি কালো আইন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

তিনি আরও বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকার যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মত প্রকাশ চিন্তার স্বাধীনতা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বন্ধের উপাদান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, খসড়া আইনেও রাখা হয়েছে। অনেকেই এই খসড়া আইনকে নিবর্তনমূলক বলে মনে করছেন।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন
জবাবে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ডিজিটালসেবা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাইবার জগতে ঝুঁকিও বাড়ছে। সাইবার অপরাধগুলো এতবেশি মারাত্মক, এতবেশি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, অর্থ উপাত্ত সুরক্ষণের জন্য এটা এতবেশি প্রয়োজন, যার ফলে ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন করা হয়।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রয়োজন, সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার পরামর্শে, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা, আইনমন্ত্রী সময়ে সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার সংস্থা, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সাইবার সিকিউরিটি আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে যেগুলো অজামিনযোগ্য ছিল সেখানে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। চারটি ধারা শুধু অজামিনযোগ্য হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটিকে উদার ভবিষ্যতমুখী বলেও উল্লেখ করেন পলক।
আইনটির খসড়া প্রকাশের পর থেকেই মানবাধিকারকর্মী সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনেও কার্যত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল বিষয়বস্তু বহাল রাখা হচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতোই এই আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা ব্যক্ত করে তারা বলছেন, প্রস্তাবিত আইনে কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হলেও অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ থেকেই যাবে।
বিলের ৪২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে সাক্ষ্যপ্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তার, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই সেখানে তল্লাশি, সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাশি এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের এখতিয়ার রয়েছে। এই ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ছিল।
: আগের মামলা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই চলবে
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা প্রচারণা চালান বা তাতে মদত দেন, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
বিলের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এরূপ কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। বিদ্যমান আইনে এই অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
বিলের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্যপ্রকাশ বা প্রচার করলে সেজন্য ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিলের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এরূপ কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক বল সম্প্রীতি বিনষ্ট করে যা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিয়ার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। এর সাজা সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
বিলের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্যকোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক সাত বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪টি ধারা অজামিনযোগ্যই থাকছে

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ১৪টি ধারার মধ্যে ১৮ () (), ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ৪৬ ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। অজামিনযোগ্য চারটি ধারা হলো ১৭, ১৯, ২৭ ৩৩। নতুন করে জামিনযোগ্য করা ২১ ধারায় সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা আগের মতোই রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারায় সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। এছাড়া ৩০ ধারায় আইনবহির্ভূতভাবেট্রানজেকশন’ (ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে লেনদেন) সংক্রান্ত অপরাধ সাজার কথা বলা আছে।
প্রস্তাবিত আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ৬টি। এখন দুটি ধারা নতুন করে জামিনযোগ্য করায় অজামিনযোগ্য ধারা রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ১৭ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশসংক্রান্ত অপরাধ দণ্ডের কথা রয়েছে। ১৯ ধারায় কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন, ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ৩৩ ধারায় হ্যাকিংসংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে আগস্ট সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করার কথা জানায় সরকার। ওই দিনই প্রস্তাবিত আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। আগস্ট তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিরওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করে সরকার। ২৮ আগস্ট মন্ত্রিসভায় খসড়া আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। খসড়া আইনটিতে অংশীজনদের মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে সমালোচনার মুখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, বিল পাসের আগে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার সুযোগ দেওয়া হবে।
এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার জাতীয় সংসদে সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছিল। শুরু থেকেই এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের পাশাপাশি দেশিবিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল।